কুট্টিমামা কান চুলকে বললে, বাঘ স্যার-ভেরি ব্যাড স্যা–আই নট লাইক স্যার
কিন্তু সায়েবরা সেকথা শুনলে তো! গোঁ যখন ধরেছে তখন গেলই। আর কুট্টিমামাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলে গেল।
গিয়ে ডুয়ার্সের জঙ্গলে এক ফরেস্ট বাংলোয় উঠল।
চারদিকে ধুন্ধুমার বন। দেখলেই পিত্তি ঠাণ্ডা হয়ে আসে। রাত্তিরে হাতির ডাক শোনা যায়বাঘ হুম হাম করতে থাকে। গাছের ওপর থেকে টুপ টুপ করে জোঁক পড়ে গায়ে। বানর এসে খামস ভেংচি কাটে। সকালে কুট্টিমামা দাড়ি কামাচ্ছিলেন। একটা বানর এসে ইলিক চিলিক এইসব বলে তাঁর বুরুশটা নিয়ে গেল। আর সে কী মশা। দিন নেই-রাত্তির নেই–সমানে কামড়াচ্ছে। কামড়ানোও যাকে বলে! দু-তিন ঘন্টার মধ্যেই হাতে পায়ে মুখে যেন চাষ করে ফেললে।
তার মধ্যে আবার সায়েবগুলো মোটর গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকল বাঘ মারতে।
মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে, তুমিও চলো।
কুট্টিমামা তক্ষুনি বিছানায় শুয়ে হাত পা ছুঁড়তে আরম্ভ করে দিলে। চোখ দুটোকে আলুর মতো বড় বড় করে, মুখে গাজলা তুলে বলতে লাগল : বেলি পেইন স্যার-পেটে ব্যথা স্যার–অবস্থা সিরিয়াস স্যার
দেখে সায়েবরা ঘোঁয়া-ঘোঁয়া–ঘ্যাঁয়োৎ-ঘ্যাঁয়োৎ করে বেশ খানিকটা হাসল।-ইউ গাঁজা-গাবিন্ডে, ভেরি নটি বলে একজন কুট্টিমামার পেটে একটা চিমটি কাটলে–তারপর বন্দুক কাঁধে ফেলে শিকারে চলে গেল।
আর যেই সায়েবরা চলে যাওয়া অমনি তড়াক করে উঠে বসলেন কুট্টিমামা। তক্ষুনি এক ডজন কলা, দুটো পাঁউরুটি আর এক শিশি পেয়ারার জেলি খেয়ে, শরীরটরির ভালো করে ফেললেন।
বাংলোর পাশেই একটা ছোট পাহাড়ি ঝরনা। সেখানে একটা শিমুল গাছ। কুট্টিমামা একখানা পেল্লায় কালীসিঙ্গির মহাভারত নিয়ে সেখানে এসে বসলেন।
চারদিকে পাখি-টাখি ডাকছিল। পেটটা ভরা ছিল, মিঠে মিঠে হাওয়া দিচ্ছিল–কুট্টিমামা খুশি হয়ে মহাভারতের সেই জায়গাটা পড়তে আরম্ভ করলেন–যেখানে ভীম বরাক্ষসের খাবার-দাবারগুলো সব খেয়ে নিচ্ছে।
পড়তে পড়তে ভাবের আবেগে কুট্টিমামার চোখে জল এসেছে, এমন সময় গ–গ
কুট্টিমামা চোখ তুলে তাকাতেই :
কী সর্বনাশ! ঝরনার ওপারে বাঘ!
কী রূপ বাহার! দেখলেই পিলে-টিলে উলটে যায়। হাঁড়ির মতো প্রকাণ্ড মাথা, আগুনের ভাঁটার মতো চোখ, হলদের ওপরে কালো কালো ডোরা, অজগরের মতো বিশাল ল্যাজ। মস্ত হাঁ করে, মুলোর মতো দাঁত বের করে আবার বললে, গর—র–র ৷
একেই বলে বরাত! যেবাঘের ভয়ে কুট্টিমামা শিকারে গেল না, সে বাঘ নিজে থেকেই দোরগোড়ায় হাজির। আর কেউ হলে তক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যেত, আর বাঘ তাকে সারিডন ট্যাবলেটের মতো টপাং করে গিলে ফেলত। কিন্তু আমারই মামা তো–ভাঙে তবু মচকায় না। তক্ষুনি মহাভারত বগলদাবা করে এক লাফে একেবারে শিমুল গাছের মগডালে।
বাঘ এসে গাছের নীচে থাবা পেতে বসল। দু-চারবার থাবা দিয়ে গাছের গুঁড়ি আঁচড়ায়, আর ওপর দিকে তাকিয়ে ডাকে : ঘঁর-র ঘুঁ–ঘু। বোধহয় বলতে চায় তুমি তো দেখছি পয়লা নম্বরের ঘুঘু!
কিন্তু বাঘটা তখনও ঘুঘুই দেখেছে-ফাঁদ দেখেনি। দেখল একটু পরেই। কিছুক্ষণ পরে বাঘটা রেগে যেই ঝাঁক করে একটা হাঁক দিয়েছে–অমনি দারুণ চমকে উঠেছে কুট্টিমামা, আর বগল থেকে কালীসিঙ্গির সেই জগঝম্প মহাভারত ধপাস করে নীচে পড়েছে। আর পড়বি তো পড় সোজা বাঘের মুখে। সেই মহাভারতের ওজন কমসে কম পাকা বারো সের–তার ঘায়ে মানুষ খুন হয় বাঘও তার ঘা খেয়ে উলটে পড়ে গেল। তারপর গোঁ-গোঁ-ঘেয়াং ঘেয়াং বলে বারকয়েক ডেকেই–এক লাফে ঝরনা পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে হাওয়া!
কুট্টিমামা আরও আধ ঘন্টা গাছের ডালের বসে ঠকঠক করে কাঁপল। তারপর নীচে নেমে দেখল মহাভারত ঠিক তেমনি পড়ে আছে তার গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। আর তার চারপাশে ছড়ানো আছে কেবল দাঁত বাঘের দাঁত। একেবারে গোনা-গুনতি বত্রিশটা দাঁত-মহাভারতের ঘায়ে একটি দাঁতও আর বাঘের থাকেনি। দাঁতগুলো কুড়িয়ে নিয়ে, মহাভারতকে মাথায় ঠেকিয়ে, কুট্টিমামা এক দৌড়ে বাংলোতে। তারপর সায়েবরা ফিরে আসতেই কুট্টিমামা সেগুলো তাদের দেখিয়ে বললে, টাইগার টুথ।
ব্যাপার দেখে সায়েবরা তো থ!
তাই তো–বাঘের দাঁতই বটে? পেলে কোথায়?
কুট্টিমামা ডাঁট দেখিয়ে বুক চিতিয়ে বললে, আই গো টু ঝরনা। টাইগার কাম। আই ডু বকসিং–মানে ঘুষি মারলাম। অল টুথ ব্রেক। টাইগার কাট ডাউন–মানে বাঘ কেটে পড়ল।
সায়েবরা বিশ্বাস করল কি না কে জানে, কিন্তু কুট্টিমামার ভীষণ খাতির বেড়ে গেল। রিয়্যালি গাঁজা-গাবিন্ডে ইজ এ হিরো! দেখতে কাকঁলাসের মতো হলে কী হয় হি ইজ এ গ্রেট হিরো! সেদিন খাওয়ার টেবিলে একখানা আস্ত হরিণের ঠ্যাং মেরে দিলেন কুট্টিমামা।
পরদিন আবার সায়েবরা শিকারে যাওয়ার সময় ওকে ধরে টানাটানিঃ আজ তোমাকে যেতেই হবে আমাদের সঙ্গে। ইউ আর এ বিগ পালোয়ান।
মহা ফ্যাসাদ। শেষকালে কুট্টিমামা অনেক করে বোঝালেন, বাঘের সঙ্গে বকসিং করে ওঁর গায়ে খুব ব্যথা হয়েছে। আজকের দিনটাও থাক।
সায়েবরা শুনে ভেবেচিন্তে বললে, অল রাইট অল রাইট।
আজকে কুট্টিমামা হুঁশিয়ার হয়ে গেছেন বাংলোর বাইরে আর বেরুলেনই না। বাংলোর বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে আবার সেই কালীসিঙ্গির মহাভারত নিয়ে বসলেন।