দারোগা বললেন, চলুন, ছাতে যাই।
কিন্তু ছাতে যেতেই দেখা গেল, তার এক কোণে ছোট একটা রুপোর ঝিনুক চিকচিক করছে।
দারোগা সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, এ ঝিনুক কার? আপনার বাড়িতে তো কোনও বাচ্চা ছেলেপুলে নেই।
মোক্ষদা মাসি ঝাঁ করে বলে ফেললেন, ওটা ঠাকুরপোর ছোট ছেলে লোটনের, মুখপোড়া কাগে নিয়ে এসেছে।
শুনেই, দারোগা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বটে! ওবাড়ি থেকে রূপোর ঝিনুক এনে আপনার ছাতে ফেলেছে। তবে তো এ কাক আপনার। দাঁড়ান—দেখাচ্ছি আপনাকে।
মেসোমশাই হাউমাউ করে উঠলেন, কিন্তু দারোগা কোনও কথা শুনলেন না। তক্ষুনি হনহনিয়ে চলে গেলেন যদু মেসোর বাড়িতে।
ওবাড়ির মাসি পুলিপিঠে তৈরি করে রেখেছিলেন, আদর করে দারোগাকে খেতে দিলেন। আর সেই ফাঁকে যদু মেসো সবিস্তারে বলে যেতে লাগলেন, মধু চাটুজ্যের কাকের জ্বালায় তিনি আর তিষ্ঠোতে পারছেন না।
তক্ষুনি—ঠন–ঠনাৎ! দারোগার সামনেই যেন আকাশ থেকে একটা চামচে এসে পড়ল।
দারোগা বললেন, এ কার চামচে?
যদু মেসো বলতে যাচ্ছিলেন, আমারই স্যার—কিন্তু পেল্লায় এক ধমকে দারোগা থামিয়ে দিলেন তাঁকে। বললেন, শাট আপ—আমার সঙ্গে চালাকি? ওই চামচে দিয়ে আমি মধুবাবুর ওখানে ওমলেট খেয়ে এলুম—এখনও লেগে রয়েছে। তা হলে কাক তো আপনারই—আপনিই তো তাকে চুরি করতে পাঠান। দাঁড়ান—দেখাচ্ছি–
যদু মেশোর দাঁতকপাটি লাগার উপক্রম! দারোগা হনহনিয়ে চলে গেলেন। তারপর পুলিশ পাঠিয়ে দুই মেসোকে থানায় নিয়ে গেলেন। বলির পাঁঠার মতো দাঁড়িয়ে রইলেন দুজন।
দারোগা চোখ পাকিয়ে বললেন, এ ওর নামে নালিশ করবেন আর?
দুই ভাই একসঙ্গে বললেন, না–না।
কোনওদিন আর ঝগড়া-ঝাঁটি করবেন?
না স্যার, কক্ষনো না।
তা হলে বলুন, ভাই-ভাই এক ঠাঁই।
ওঁরা বললেন, ভাই-ভাই এক ঠাঁই।
এ ওকে আলিঙ্গন করুন।
দুজনে পরস্পরকে জাপটে ধরলেন—প্রাণের দায়েই ধরলেন। আর মোটা মেসোমশাইয়ের চাপে রোগা যদু মেশোর চোখ কপালে উঠে গেল।
তারপর? তারপর থেকে দুভাই প্রাণের প্রাণ। কী যে ভালোবাসা—সে আর তোকে কী বলব প্যালা! তাই বলছিলুম, কাক অতি মহৎ-হৃদয় প্রাণী, পৃথিবীর অনেক ভালো সে করে থাকে—তাকে ছুঁচো-টুচো বলতে নেই!
গল্প শেষ করে টেনিদা আমাকে দিয়ে দু আনার আলুর চপ আনাল। একটু ভেঙে যেই মুখে দিয়েছে, অমনি–
অমনি ঝপাট!
কাক এসে ঠোঙা থেকে একখানা আলুর চপ তুলে নিয়ে চম্পট।
অতি মহৎ-হৃদয় প্রাণীসন্দেহ কী!
কুট্টিমামার দন্ত-কাহিনী
আমি সগর্বে ঘোষণা করলাম, জানিস, আমার ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে।
ক্যাবলা একটা গুলতি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে একটা নেড়ী কুকুরের ল্যাজকে তাক করছিল। কুকুরটা বেশ বসে ছিল, হঠাৎ কী মনে করে ঘোঁক শব্দে পিঠের একটা এঁটুলিকে কামড়ে দিলে তারপর পাঁই-পাঁই করে ছুট লাগাল। ক্যাবলা ব্যাজার হয়ে বললে, দ্যুৎ। কতক্ষণ ধরে টার্গেট করছি ব্যাটা পালিয়ে গেল। আমার দিকে ফিরে বললে, তোর ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে–এ আর বেশি কথা কী। আমার বড় কাকা, মেজ কাকা, রাঙা কাকা সবাই দাঁত বাঁধিয়েছে। আচ্ছা, কাকারা সকলে দাঁত বাঁধায় কেন বল তো? এর মানে কী?
হাবুল সেন বললে, হঃ! এইটা বোঝেস নাই। কাকাগো কামই হইল দাঁত খিচানি। অত দাঁত খিচালে দাঁত খারাপ হইব না তো কী?
টেনিদা বসে বসে এক মনে একটা দেশলাইয়ের কাঠি চিবুচ্ছিল। টেনিদার ওই একটা অভ্যেস কিছুতেই মুখ বন্ধ রাখতে পারে না। একটা কিছু-না-কিছু তার চিবোনো চাই-ই চাই। রসগোল্লা, কাটলেট, ডালমুট, পকৌড়ি, কাজু বাদাম–কোনওটায় অরুচি নেই। যখন কিছু জোটে না, তখন চুয়িংগাম থেকে শুকনো কাঠি–যা পায় তাই চিবোয়। একবার ট্রেনে যেতে যেতে মনের ভুলে পাশের ভদ্রলোকের লম্বা দাড়ির ডগাটা খানিক চিবিয়ে দিয়েছিল–সে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড! ভদ্রলোক রেগে গিয়ে টেনিদাকে ছাগল-টাগল কী সব যেন বলেছিলেন।
হঠাৎ কাঠি চিবুনো বন্ধ করে টেনিদা বললে, দাঁতের কথা কী হচ্ছিল র্যা? কী বলছিলি দাঁত নিয়ে?
আমি বললাম, আমার ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে।
ক্যাবলা বললে, ইস–ভারি একটা খবর শোনাচ্ছেন ঢাকঢোল বাজিয়ে! আমার বড় কাকা, মেজ কাকা, ফুলু মাসি
টেনিদা বাধা দিয়ে বললে, থাম থাম্ বেশি ফ্যাচফ্যাচ করিসনি। দাঁত বাঁধানোর কী জানিস তোরা? হুঁ! জানে বটে আমার কুট্টিমামা গজগোবিন্দ হালদার। সায়েবরা তাকে আদর করে ডাকে মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে। সে-ও দাঁত বাঁধিয়েছিল। কিন্তু সে-দাঁত এখন আর তার মুখে নেই–আছে ডুয়ার্সের জঙ্গলে!
–পড়ে গেছে বুঝি?
পড়েই গেছে বটে!–টেনিদা তার খাঁড়ার মতো নাকটাকে খাড়া করে একটা উঁচুদরের হাসি হাসল–যাকে বাংলায় বলে হাই ক্লাস! তারপর বললে, সে-দাঁত কেড়ে নিয়ে গেছে।
দাঁত কেড়ে নিয়েছে? সে আবার কী? আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, এত জিনিস থাকতে দাঁত কাড়তে যাবে কেন?
–কেন? টেনিদা আবার হাসল : দরকার থাকলেই কাড়ে। কে নিয়েছে বল দেখি? ক্যাবলা অনেক ভেবে-চিন্তে বললে, যার দাঁত নেই।
ইঃ, কী পণ্ডিত! টেনিদা ভেংচি কেটে বললে, দিলে বলে! অত সোজা নয়, বুঝলি? আমার কুট্টিমামার দাঁত যে-সে নয়–সে এক একটা মুলোর মতো। সেবাঘা দাঁতকে বাগানো যার-তার কাজ নয়।
–তবে বাগাইল কেডা? বাঘে? হাবুলের জিজ্ঞাসা।