ঝগড়া মানে? রামঝগড়া যাকে বলে। সেই কোক্কালে দুজনের ভেতরে কী হয়েছিল কে জানে, সেই থেকে কেউ আর কারও মুখ পর্যন্ত দেখেন না। যদুবাবু খুব রসগোল্লা খেতে ভালোবাসেন বলে মেসোমশাই মিষ্টি খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন—সকালে বিকেলে স্রেফ দু বাটি করে নিমপাতা বাটা খান। আর মেসোমশাই কোঁচা দুলিয়ে ফিনফিনে ধুতি পরেন বলে যদুবাবু মানে যদু মেসো, মোটা মোটা খাকি হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ান।
আমি বললুম, ব্যাপার তো খুব সাংঘাতিক।
সাংঘাতিক বলে সাংঘাতিক! একেবারে পরিস্থিতি বলতে পারিস। শেষ পর্যন্ত এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেল যে দুজনে লাঠালাঠি হওয়ার জো।
হয়েছিল কি, মেসোমশাই আর যদু মেশোর দুই বাড়ির সীমানার ঠিক মাঝবরাবর একটা কয়েতবেলের গাছ। এদিকে বেল পড়লে এরা কুড়োয়, ওদিকে পড়লে ওরা। একদিন সেই গাছে কোত্থেকে একটা চাঁদিয়াল ঘুড়ি এসে লটকে গেল।
যদু মেসোর ছেলে পল্টন তো তক্ষুনি কাঠবেড়ালীর মতো গাছে উঠে পড়েছে। আর গাছে কাকের বাসানতুন বাচ্চা হয়েছে তাদের, পল্টনকে দেখেই তারা খা-খা করে তেড়ে এল। পল্টন হাঁ-হাঁ করে ওঠবার আগেই তাকে গোটা দশেক রাম ঠোক্কর।
চাঁদিয়াল ঘুড়ি মাথায় উঠল, বাবা রে মা-রে বলতে বলতে পল্টন গাছ থেকে কাটাকুমড়োর মতো ধপাৎ! ভাগ্যিস গাছের নীচে যদুমেসোর একটা খড়ের গাদা ছিল—তাতে পড়ে বেঁচে গেল পল্টননইলে হাত-পা আর আস্ত থাকত না।
মনে রাগ থাকলে—জানিসই তো, বাতাসের গলায় দড়ি দিয়েও ঝগড়া পাকানো যায়। পল্টন ভ্য-ভা করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটল বাড়ির দিকে আর লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এলেন যদু মেসো। রাগ হলে তাঁর মুখ দিয়ে হিন্দী বেরোয়, চিৎকার করে তিনি বলতে লাগলেন : এই, তুমারা কাগ কাহে হামারা ছেলেকে ঠোকরায় দিয়া?
মেসোমশাই-ই বা ছাড়বেন কেন? তিনিও চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ও কাগ হামারা নেহি, তুমারা হ্যায়। তুমি উসকো পুষা হ্যায়।
তুমি পুষা হ্যায়।
তোম্ পুষা যায়।
শেষে দুজনেই তাল ঠুকে বললেন, আচ্ছা-আচ্ছা, দেখ লেঙ্গা।
ওরা আর কী দেখবেন, মজা দেখতে লাগল কাকেরাই। মানে নতুন বাচ্চা হয়েছে, তাদের দুটো ভালোমন্দ খাওয়াতে কোন্ বাপ-মার ইচ্ছে হয় না তাই বল? তার ওপর কাগের ছা রাত্তির-দিন হাঁ করেই রয়েছে, তাদের রাক্ষুসে পেট ভরানোই কি চারটিখানি কথা? কাজেই পোকামাকড়ে আর শানায় না বাধ্য হয়েই কী বলে না বলিয়া পরের দ্রব্য গ্রহণ করতে হয় তাদের। ধর—সারা সকাল খেটেখুটে মোক্ষদা মাসি এক থালা বড়ি দিয়েছেন, কাকেরা এসে পাঁচ মিনিটে তার থ্রি-ফোর্থ ভ্যানিশ করে দিলে। ওদিকে আবার যদু মেসোর মেয়ে—মানে আমার বঁচিদি মাছ কুটে পুকুরে ধুতে যাচ্ছে—ঝপাট–ঝপাট-খান দুই মাছ তুলে নিয়ে চম্পট!
কাজেই ঝগড়াটা বেশ পাকিয়ে উঠল। কাক নিশ্চিন্ত কাজ গুছিয়ে যাচ্ছে আর দুই মেসো সমানে এ ওকে শাসাছেন : দেখ লেঙ্গা-দেখ লেঙ্গা!
শেষে আমার রিয়্যাল মেসোমশাই ভাবলেন, একবার সরেজমিনে তদন্ত করা যাক। মানে, কয়েতবেল গাছে যে-ডালে কাকের বাসা সেটা তাঁর দিকে না যদু মেশোর দিকে। গুটি গুটি গিয়ে যেই গাছতলায় দাঁড়িয়েছেন, ব্যস!
অমনি খা-খা করে আওয়াজ, আর টকাস টকাস! মেসোমশাইয়ের মাথায় টাক আছে। আগেই বলেছি, সেখানে কয়েকটা ঠোকর পড়তেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালেন তিনি। আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন : কিকো কাক, এখন আমি বুঝতে পারা হ্যায়।
ওদিকে যদু মেসোও ভেবেছেন, কাকের বাসাটা কার দিকে পড়েছে দেখে আসি। যদু মেসো রোগা আর চটপটে, তায় হাফপ্যান্ট পরেন, তিনি সোজা গাছে উঠতে লেগে গেলেন। যেই একটুখানি উঠেছেন—অমনি কাকদের আক্রমণ! মেরে ফেললে–মেরে ফেললে–বলে যদু মেসোও খড়ের গাদায় পড়ে গেলেন, আর চেঁচিয়ে উঠলেন : কিকা কাক, এখুনি প্রমাণ হো গিয়া।
মেসোমশাই সোজা গিয়ে থানায় হাজির। দারোগাকে বললেন, যদু চাটুজ্যের পেট ক্রো আমার ফ্যামিলিকে ঠোকরাচ্ছে, আমার সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলছে। আপনি এর বিহিত করুন।
—পেট ক্রো। কিছু বুঝতে না পেরে দারোগা একটা বিষম খেলেন।
—আজ্ঞে হ্যাঁ, পোষা কাক। যদু চাটুজ্জের পোষা কাক।
দারোগা বললেন, ইমপসিবল! কাক কখনও পোষ মানে? কাক কারও পোষা হতে পারে?
মেসোমশাই বললেন, পারে স্যার। আপনি ওই ধড়িবাজ যদু চাটুজ্যেকে জানেন না। ওর অসাধ্য কাজ নেই।
দারোগা তখন কান পেতে সব শুনলেন। তারপর মুচকে হেসে বললেন, আচ্ছা, আপনি এখন বাড়ি যান। আমি বিকেলে আপনার ওখানে যাব তদন্ত করতে।
মেসোমশাই বেরিয়ে যেতে না যেতেই যদু মেসে গিয়ে দারোগার কাছে হাজির।
স্যার, মধু চাটুজ্যে কয়েতবেল গাছে কাক পুষেছে আমার সঙ্গে শত্রুতা করবার জন্যে। সেই কাকের উপদ্রবে আমি ধনে-প্রাণে মারা গেলুম।
দারোগা ভুরু কুঁচকে বললেন, পেট ক্রো?
নির্ঘাত।
দারোগা যদু মেসোর কথাও সব শুনলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। আমি বিকেলে যাব আপনার ওখানে তদন্ত করতে।
বাড়ি ফিরে দুই মেসোই সমানে এ-ওকে শাসাতে লাগলেন : আজ বিকালে পুলিশ আয়েগা, তখন বোঝা যাবে কৌন কাক পুষা হ্যায়।
দাবোগা এসে প্রথমেই মেসোমশাই—অর্থাৎ মধু চাটুজ্যের বাড়িতে ঢুকলেন। মেসোমশাই তাঁকে আদর করে বলেন, খুব করে চা আর ওমলেট খাওয়ালেন, কাকের বিশদ বিবরণ দিলেন। তারপর বললেন, ও সব যদু চাটুজ্যের শয়তানি। দেখুন না, দুপুরবেলা ছাতে আমার গিন্নি শুকনো লঙ্কা রোদে দিয়েছিলেন, তার অদ্ধেক ওর কাকে নিয়ে গেছে।