বিনোদবাবুর কাছ থেকে এনেছেন? তা হলে দিয়ে আসুন সে ত ভুলে গেলাম স্যার।
সুহাস তার ব্যাগ থেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে বলল, এখন দিয়ে আসুন। পরে, বিনোদবাবুর কাছ থেকে নিয়ে আমাকে দিয়ে দেবেন।
তা হলে আপনি একটু দাঁড়ান স্যার, আমি দিয়ে আসি।
সুহাস দাঁড়িয়ে থাকল। তার সামনেই প্রিয়নাথ লটারির রিক্সাটার ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল। দাদা, আমাদের সাহেব খুব খুশি হয়েছেন। এই দুটো টাকা রাখুন, চা-সিঙাড়া খাবেন।
ছেলেটি মাইক সামনে নিয়েই রেগে উঠল, ধুত মশাই, চা-সিঙাড়া খাওয়াতে হয় আপনি এনে খাওয়ান, আমাদের হাতে টাকা ধরাচ্ছেন কেন? মাইকে এত জোরে কথাটা হওয়ায় প্রিয়নাথ চমকে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সুহাস এদিকেই তাকিয়ে।
আচ্ছা দাদা, আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, টাকাটা ভাঙিয়ে দিন।
সামনের চায়ের দোকানটাতে গিয়ে দুটো টাকা দিয়ে বলল, ঐ লটারির রিক্সাতে তিনটে চা আর সিঙাড়া পাঠিয়ে দেন। টাকা দেয়া, বিশ পয়সা ফেরত নেয়া এই সবের ভেতরে প্রিয়নাথ সাতটি টাকা পকেটে রেখে দিল। দাদা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেন বলে দৌড়ে সুহাসের কাছে যেতে গিয়ে তার স্যান্ডেলের মাথাটা ভাজ হয়ে যাওয়ায় একটা হোঁচট খেল। সামলে, হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে বলল, স্যার, চা-সিঙাড়া খাওয়াতে হল, বলে এক টাকা কুড়ি পয়সা সুহাসকে ফেরত দিল। সুহাস বলল, এটা আর বিল করবেন না। ঐ সাত টাকা নিয়ে আমাকে দিয়ে দেবেন।
আপনি একটু বলে দেবেন স্যার, উনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না।
না না, করবেন। আমরা সবাই ত ঢুকতে-ঢুকতেই মাইকে শুনলাম।
স্যার, এই দিকে–প্রিয়নাথ সুহাসকে হাটে ঢোকার পথ দেখায়।
.
০০৮.
হাট কত রকমের
হাট বসা, জমে ওঠা ও ভাঙার একটা যেন বাধা গৎ আছে।
কিন্তু সব হাটের এক রকম নয়। এদিকে চ্যাংমারির হাট বা বড়দিঘির হাট সপ্তাহে একদিন বসে–মোটামুটি সংসারের কেনাবেচার জন্য। গায়ের লোকজনই কেউ কেউ দোকান দিয়ে আসছে। বড়দিঘির হাটে চাবাগানের মজুররাও একটা বড় খদ্দের। তাদের কেনার মত জিনিশপত্রও আসে। কিন্তু সেসব হাট বসে বিকেলের দিকে। তার পর সন্ধ্যার একটু পরেই ভাঙতে থাকে।
ওদলাবাড়ি-লাটাগুড়ি হাট এখন বেশ বড়। বাস রাস্তার ধারে বলে তাড়াতাড়ি বসে আর দেরিতে ভাঙে। নদীর বাঁধের কাজকর্মের জন্য দুদিকেই প্রায় সারা বছর মাটিকাটা-পাথরভাঙা লোকজন থাকে। তাছাড়া ফরেস্টের লোকজনের সংখ্যাও নেহাত কম হবে না। ৬৮সালের বন্যায় যেসব ফরেস্টের গাছ-গাছড়া ভেঙে বা ভেসে গেছে-সেইসব ফরেস্ট এখন সরকার পুরো ফাঁকা করে দিচ্ছে। হয়ত ওখানে নতুন করে বন তৈরি হবে। বা, এখন ফেলে রাখবে। ফলে, সারা বছরই প্রায় ফরেস্টের গাহ চলছে। গ্রামে বিদ্যুতের জন্য শালের খুঁটিও বিক্রি হচ্ছে গত কয়েক বছর। তার জন্যেও ত প্রায় সারা বছরই ফরেস্টে কাজ। তাই ওদলাবাড়ি আর লাটাগুড়ির হাট বেশ বড়। কিন্তু সেও ত কেনাবেচার হাটই আসলে ব্যবসার হাট নয়। বসে দুপুরের দিকে, তার পর চলতে থাকে। গেল বছর লাটাগুড়ির হাটে টিনের শেড তুলে সাইকেলের দোকান দিয়েছে ছচ্ছড়িয়া। হাটবারের দিন, বুধ আর শনিত, খোলে। ওদলাবাড়িতে ত সাইকেল-রেডিওর দোকান আগে থাকতেই আছে। কিন্তু যত বড়ই হোক, এসব হাট তখদ্দের বুঝে চলে। খদ্দেরের হাতে টাকা ত হাট জমল। খদ্দেরের হাতে টাকা নেই ত হাট ফাঁকা। ঐ-সব হাট-বাজারের মত, দোকানের মত। কিন্তু হাট বললে ত এই ক্রান্তির হাট, ধূপগুড়ির হাট, চালসার হাট। এ-সব হাটে যেন খদ্দের নেই, দোকানদারও নেই, শুধু হাটটাই আছে। হাট জমবেই হাটের মত, আর খদ্দের-দোকানদাররা হাটের সঙ্গে নিজেদের শুধু মানিয়ে নেবে। হাটের ভূগোল যে জানে সে হয়ত গলিখুঁজি দিয়ে ঢুকতে পারে বেরতে পারে, কিন্তু যে চেনে না সে কোনো এক দিক দিয়ে ঢুকতে পারলেও–বেরবার সময় রাস্তা আর খুঁজে বের করতে পারবে না। যেন হাটটা তাকে গিলে খেয়ে শেষে উগরে দেবে।
এ হাটগুলো যে কখন বসে কেউ টের পায় না। হাটের ওখানে পাকাবাজার ত একটা আছেই। তাতে রোজকার বাজার চলে। তা ছাড়াও পাকাঘর, পাকাদোকান, পাকাগুদামে রেশন, মিষ্টির দোকান, ওষুধের দোকান, কাপড়ের দোকান, শুকনো মশলার দোকান-গুদাম, এফ-সি-আই-এর গুদাম, সারের এফ-সি-আই-এর গুদাম ও দোকান, কোঅপারেটিভ খানতিন-চার, গোটা দুয়েক কিশোর বা যুব সজল-এ সবও ত রোজকারই।
ধূপগুড়ি হাটের একটু দক্ষিণে পাঞ্জাবি ড্রাইভারদের একটা ধাবাও হয়েছে। ওভারসিং রায়ের বাড়ির পশ্চিমে আগেকার দারিঘরটার জায়গায়, এখন লম্বা-খোলা ঘর। সামনে সারি-সারি খাঁটিয়া পাতা। রাবণের সাইজের একটা উনুন। ঐ শেডেরই এক কোণে পাঠা আর মুরগি বাধা। ধূপগুড়ি দিয়ে ডাইনে থেকে আসামে চলে যায় দূরপানার ট্রাক। ওভারসিং রায় জায়গাটা ভাড়া দিয়ে, টান বাঁশের বেড়ায় তার বাড়িটা আলাদা করে নিয়েছে। তার পর বাড়ির উত্তরে দারিঘর বানিয়ে বাড়ির ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ক্রান্তি, চালসা, মেটেলিতে ধাবা নেই বটে, তবে ধাবা সাইজের মিষ্টির দোকান আছে, আর ট্রাক আছে। এই সবে ত এসব হাট, হাটবারের দিন ছাড়াও, জমজমাটই থাকে।
তাই হাটবারে বোঝাই যায় না, কখন হাটটা বসে। আগের দিন দুপুর থেকেই বাশের গাড়ি আসতে শুরু করে। ট্রাক অবিশ্যি সব সময় হাটবার মিলিয়ে আসে না। কিন্তু হাটবারের আগে গুদাম ত ভরতেই হয়। ফলে হাটবারের আগের দিনই কোনো-এক সময় থেকে শুধু গুরুর গাড়ির ক্যাচক্যাচ আওয়াজ উঠতে থাকে। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা জুড়ে এই আওয়াজেই যেন পরের দিনের হাটবারটা কাছে আসে। আর তখন থেকেই একটু-একটু করে বাতাস ভারী হয় মানুষের গলার আওয়াজে। বনে বৃষ্টি হলে বাতাস। যেমন ভারী হয়ে গায়ে লাগে, এই হাটগুলো লাগার আগে তেমনি মানুষের স্বরে ভারী বাতাস কানে লাগতে থাকে। এই আওয়াজটাই বাড়তে থাকে প্লেনের মত। প্রথমে গুঞ্জন, তারপর ধীরে-ধীরে আওয়াজটা বাড়তে বাড়তে মিলিয়ে যায়, শেষে আবার গুঞ্জন। কিন্তু প্লেনের মত ত মাত্র কয়েকটি মিনিটে এটা ঘটে না–ঘটে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ধরে। ফলে গুঞ্জনটা শুরু হলে হয়ত বোঝা যায়, কিংবা গুঞ্জনটা শুনবার মত হয়ে উঠলে। তার পর, সেই গুঞ্জনটা ত বিরতিহীন চলতে থাকে, বাড়তে থাকে। কখন যে সেটা উঠছে তার কোনো চিহ্ন দেয়া যায় না, কিন্তু কোনো এক সময় যেন মনে হয় সারা দুনিয়া, জুড়ে হাটের ঐ আওয়াজটাই উঠছে, মাথার ওপর প্লেনের মত বা ফরেস্টের ভেতর ঝিঁঝির ডাকের মত। তার ওপর কোনো এক সময় নিশ্চয়ই গুঞ্জনটা আবার নামতে শুরু করে। কিন্তু নামার সেই সময়টা ত ধরা যায় না। ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ ধরেই নামতে থাকে। হঠাৎ যখন খেয়াল হয়, তখন, দেখা যায় তার আগেই অনেকটা খালি হয়ে গেছে, যেন রোজকার চেহারায় ফিরে আসছে। বোঝাই যায় না এত বড় হাটটা কখন এত ফাঁকা হয়ে গেল।