আসলে ভয় পায়–এদের আতিথেয়তা মেনে নিলে তার পর আবার কোনো চাপ তৈরি না হয়। সে এক নিজের জন্য রান্নার ব্যবস্থাটা রেখে বাকিদের ইচ্ছে মত ব্যবস্থা করতে বলতে পারে। কিন্তু তা হলেও ত এরা যার যার, বাড়িতে বা সাহায্যে, খাওয়া-দাওয়া করবে তাদের জন্য সুবিধে সুহাসের কাছ। থেকে আদায় করে দিতে পারে।
অগত্যা তাকে বলতে হয়, দেখুন, আমাদেরও ত একটা সুনাম-দুর্নামের ব্যাপার আছে। আমাদের কাজকর্ম চলুক। আমরা ত বেশ কিছুদিন এখানে আছি। সব চুকেবুকে যাওয়ার পর আমাদের না-হয় আপনারা একদিন ভাল করে খাইয়ে দেবেন। তবে এটা আমার কথা। আমি ক্যাম্পেই খাব। আপনারা এদের সঙ্গে কথা বলুন। এঁরা যা বলেন, এদের ব্যবস্থা সেই মত হবে। চলুন প্রিয়নাথবাবু, হাটটা ঘুরে আসি। সুহাস পেছন ফিরে হাটের দিকে রওনা দেয়।
পেছন থেকে বিনোদবাবু বলেন, স্যার, অনাথও আপনাদের সঙ্গে যাক না, একা প্রিয়নাথ। কথার উত্তর না দিয়ে সুহাস এগিয়ে যায়।
.
০০৬.
প্রিয়নাথের সাহেব ও হাটের নাচ
এ হাটটা বেশ বড় হাট, না? সুহাস জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ, স্যার, এদিককার সবচেয়ে বড় হাট।
কী কী বিক্রি হয়, মানে পাইকারি বিক্রি?
ঠিক তা ত বলতে পারব না স্যার, তবে যেরকম পাহাড়ের মত শুকনো লঙ্কা আর পাট তাতে পাইকার ছাড়া আর অত মাল কে কিনবে?
শুকনো লঙ্কা? শুকনো লঙ্কা এদিকে কোথায় তৈরি হয়, মানে এখানে কি শুকনো লঙ্কা এত-শুনি নি ত?
প্রিয়নাথ হাটটার একটা আন্দাজ পেয়ে গিয়েছিল। সেই দোকানপাতির সদর রাস্তা আর এই হাট কমিটির ঘরের লাইন এই দুটো বোধ হয় পুব-পশ্চিমে। এখন তারা উত্তরের মাঠটা দিয়ে গিয়ে রাস্তায় পড়বে, সেখান থেকে হাটে ঢুকবে। মাঠ দিয়ে তারা খানিকটা এগবার পর বোঝে, ঘাস দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকার হয়ে আসছে আর একটু এগতেই মাঠের মধ্যে দুটি-তিনটি কুপি জ্বলছে, দেখা যায়। ওখানে হাড়িয়া বিক্রি হচ্ছে। সুতরাং সাহেবকে নিয়ে প্রিয়নাথ আর-একটু উত্তরে যায়। ঘুরতেই ঢোলকের আওয়াজ। নাচটা এখনো চলছে? ওরা কতক্ষণ নাচবে?
নাচছে স্যার।
কারা?
এই চা বাগানের কুলি-মজুর, হাটের দিন পেট ভরে হাড়িয়া খেয়েছে আর ঢোল বাজিয়ে নাচছে।
হ্যাঁ, এখানে চা-বাগান ত প্রচুর, ট্রাইব্যাল পপুলেশনওকথাটা শেষ করে না সুহাস, থেমে যায়। সাহেব আরো কিছু বলেন কি না অপেক্ষা করে প্রিয়নাথ বলে, হ্যাঁ স্যার।
দাঁড়ান, দেখি। তাদের সামনে তখন নাচটা। তারা নাচের পেছনে। মুখটা হাটির দিকে। নাচের মুখটাও হাটের দিকে। যেমন দেখা যায় ছবিতে, ফোটোতে, সিনেমায়, অবিকল তেমনই–এ-ওর কোমরে হাত দিয়ে জড়িয়ে একটা বন্ধনীর মত করে একই তালে দু-পা এগচ্ছে আর এক-পা পিছচ্ছে আর সেই আগু-পিছুর মধ্যেই দলটা একটু ঘুরে যাচ্ছে। এ রকম করে করে পুরোটাই তারা ঘুরবে আর ঘুরতে থাকবে। আর যে ঢোলক বাজাচ্ছে সে ঐ বন্ধনীর দুই মাথার মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটাতে–ছবিতে, ফোটোতে, সিনেমায়, যেমন হয়। সুহাসদের সামনে কিছুদূরে হাটের দোকানপাট, চালাঘর। তাতে আলো জ্বলছে। চালাঘরের ছায়া যেন বাতাসে পড়েছে, বা ওখানে কিছু কিছু গাছও ত আছে। এখানে মাথার ওপরে আকাশ। সেই অসম্পূর্ণ বৃত্তের এগনো-পিছনোর সময় কখনো আকাশের শেষ আলো এসে পড়ছে, কখনো সামনের হাটের ছায়াতে সেই প্রায়বৃত্ত হারিয়ে যাচ্ছে। নাচটীর আবর্তনকে দেখাচ্ছে, যেন কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার মত। এত কাছ থেকেই দেখছে, তবু ঢোলের আওয়াজটাকে মনে হয় যেন পাহাড়-টিলাবনের ভেতর থেকে আসছে।
স্যার, চলুন না সামনে, নাচ দেখবেন। চেয়ার নিয়ে আসি।
সুহাস প্রায় শিউরে উঠে বলে, না না, চলুন হাটে যাই
সুহাস আবার চলতে শুরু করে। প্রিয়নাথ পেছনে।
.
০০৭.
প্রিয়নাথের সাহেব ও হাটের মাইক
সেই মিষ্টির দোকানটাতে তিন-চারটে হ্যাজাক। প্রিয়নাথ দেখে লটারির রিক্সাটাতেও মোমবাতি, আসুন, এক টাকার বদলে লক্ষ টাকা। সুহাস একটু এগিয়ে গেছে দেখে প্রিয়নাথ দৌড়ে লটারিঅলার সামনে গিয়ে বলে, এখন একটু বলুন না দাদা, আমাদের সাহেব এসেছেন। বলে আর দাঁড়ায় না, দৌড়ে আবার সুহাসের পেছনে পৌঁছে যায়। আপনাদের এই হাটে ত কত কী-ই ঘটছে রোজ। হ্যাঁ কটা? দুটো, এই যে নিন দাদা। এই ত কাল এখানে হলকা ক্যাম্প বসবে
প্রিয়নাথ সুহাসকে ডাকে, স্যার।
বলুন।
আমাদের ক্যাম্পের অ্যালাউন্স দিচ্ছে।
সেই ক্যাম্পে ত আপনারা সবাই আসবেন। আপনাদের জমিজমার বিচার হবে। কিন্তু এই হাকিমের চাইতেও এক বড় হাকিম আছে। সেখানে বিচার হয় আমাদের তগদিরের, ভাগ্যের। কে জানে, আপনার জন্য কী বিচার হয়ে আছে?
মাত্র এক টাকার বিনিময়ে সেই বিচার আপনারা জানতে পারবেন। কে জানে, আপনিই হয়ত এক লক্ষ টাকার প্রাইজটা পাবেন। কিন্তু টিকিট না কাটলে ত আর পাবেন না।
সুহাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল। তারপর হেসে ফেলল, এ আপনি কোত্থেকে জোগাড় করলেন?
স্যার, দেখলাম এখানে কোনো ঢোলঅলা নেই। এমনকি টিনঅলাও পেলাম না। তাই বাধ্য হয়ে স্যার…ওরা রাজি হল, কিন্তু রেটটা একটু হাই নিল।
তা ত নেবেই। মাইক বলে কথা।
ওরা দশ টাকাই চেয়েছিল, আমি বলেকয়ে সাত টাকায় নামিয়েছি।
তা হলে আর এমন-কি বেশি?
স্যার, আমার কাছে ত অত টাকা ছিল না। বললাম, আপনারা এলে দিয়ে দেব।