খানিকটা গিয়ে প্রিয়নাথ দাঁড়িয়ে পড়ে, ছেলেটি সত্যিই বলে কি না শুনতে। না বললে তার কিছু। করার নেই। বললেও তার কিছু করার নেই। ক্যাম্পে লোকজন জমলে লটারির রিক্সা আর আসবে না কেন, নিজের থেকেই আসবে। তাতে প্রিয়নাথেরও কিছু করার নেই। ছেলেটি একবারও বলে কিনা এইটি সে জেনে তবে সেই ঘর খুঁজতে যাবে।
কটি দাদা?
তু বল না কঠো?
তু বল মাইকে মদেশিয়া মেয়ের রিনরিন গলা।
লে লে শুন। তু আঁখ বুজা কর। উসকো বাদ ই টিকিটপর হাত লাগা দে। যো উঠবেক, উ আমি কিন লিব। লে আখ বুজা কর। খিলখিল হাসিটাও মাইকে এসে ব্রজে। চা বাগানের কোনো মাতাল মজুর-মজুরনির কাণ্ড। এই দেখুন, লটারির টিকিট কিনতেও লটারি হচ্ছে। চোখ বুজে যতগুলো টিকিট উঠবে, ততগুলোই কিনবে এই, বলে ছেলেটি থেমে যায়, এরা, আসুন, যা, চোখ বন্ধ করুন। আবার মাইকে খিলখিল হাসি।
.
০০৫.
প্রিয়নাথের সাহেব ও হাট কমিটি
হাট কমিটির ঘরের সামনে জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে, দূর থেকে প্রিয়নাথ দেখল। সাহেবরা এসে গেছেন। সে হটার গতি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাড়াতাড়ি হাঁটার প্রধান অসুবিধে তার স্যান্ডেল। ঐ হাওয়াই-এর খাপে খাপে তার পা এমনই মিশে আছে যে, যেরকম হাঁটলে গোড়ালির বাইরে সোলের মাথা-অংশটা তার পায়ের পাতার সঙ্গে ফর ফর করে লাগতে পারে, তার চাইতে বেশি জোরে হাঁটলেই স্যান্ডেলটা আটকে যায়। তখন আঙুলের তলায় সোলের যে অংশটুকু, তাও বেরিয়ে আসতে চায়, যেন স্যান্ডেলটা উল্টে আঙুলের সামনে চলে যাবে বা ফিতেটা তলা থেকে খুলে আসবে। ফিতেটা যাতে তলা থেকে খুলে না আসে সেজন্যে আবার সেফটিপিন দিয়ে আটকানো বটে কিন্তু সোলের সেই অংশটা ছিঁড়েও ত সেফটিপিনটা খুলে যেতে পারে। সুতরাং তেমন তাড়া থাকলে স্যান্ডেল খুলে হাতে নেয়াই ভাল। কিন্তু এ-দূরত্বটা এত বেশি নয় যে অতটা করার দরকার হবে। সে ত সব নিয়মমাফিকই করেছে তা হলে আর দৌড়াদৌড়ির দরকার কী? কিন্তু তার স্যান্ডেলের জন্য প্রিয়নাথ জোরে হাঁটতে পারে না অথচ তার পদক্ষেপে সেই দ্রুত হাঁটার বেগ এসে যায়–এই দোটানায় প্রিয়নাথের এইরকম হাটার সময় তার কোমরটা সমনে এগিয়ে যায় আর পা-টা থাকে পেছিয়ে। স্যান্ডেলের সঙ্গে পায়ের দোটানায় হাঁটুতে সব সময়ই একটা মোচড় আসে, যেন প্রত্যেকবার পা ফেলার সময় হাঁটু দুটো একটা করে পাক খায়।
প্রিয়নাথের সাহেব মাঠের ভেতর একটা চেয়ারে বসে ছিল। তার সামনে, কিন্তু কিছু দূরে, জিপ গাড়িটা দাঁড়িয়ে। প্রিয়নাথ পেছন থেকেই বলে, স্যার, এসে গেছেন!
সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়নাথকে দেখে বললেন, আরে, প্রিয়নাথবাবু। আপনি একেবারে মাইক-টাইক জোগাড় করে ফেললেন কোত্থেকে?
প্রিয়নাথ একগাল হেসে ফেলল–তা হলে স্যার আপনারা বেশিক্ষণ আসেন নি। তা স্যার ঘরদোর সব বলে বারান্দার দিকে তাকায়। বারান্দায় তাদের অফিসের লোকজন আর আরো দু-একজন। বারান্দায় উঠতে-উঠতে প্রিয়নাথ দেখে ঘরদোর সবই গোছানো, পরিষ্কার, ধোয়া। মালপত্র একটা ঘরের মেঝেতে ছড়ানো।
এই যে প্রিয়নাথদা, তোমাকে পাঠানো হল আগে যে সব বন্দোবস্ত করে রাখবে আর আমরা এসে দেখি প্রিয়নাথদা নোপাত্তা। শেষে নিজেদেরই সব করে নিতে হল। অনাথ বলল।
পাঁচ মিনিট আগেও দেখে গেছি স্যার, আপনারা আসেন নি, এর মধ্যে হুস করে এসে পড়লেন। অনাথের কথার জবাব না দিয়ে প্রিয়নাথ সাহেবকে বলে। ঘর তিনটি পর পর দেখে প্রিয়নাথ ফিরে আসে, এ ত সব পাকা বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে।
সে কী? এ-সব তুমি করো নি? আমরা ভেবেছি তুমিই সব ঠিকঠাক করে রেখেছ– বিনোদবাবু বললেন।
তা হলে ত আমাকে কাল ছাড়তে হত বাবু। আজ রওনা দিলাম এই আপনাদের আগে বাসে, আর পৌঁছলাম ত মাত্র ধরেন ঘণ্টাখানেক আগে।
তাও আবার আপনার ঐ স্যান্ডেল, এবার পেছন থেকে জ্যোৎস্না এসে বলে, আমরা ত ভাবলাম আপনি না এলেও আপনার স্যান্ডেল ঠিক আসবে।
দাঁড়ান, এই সাইনবোর্ডটা আগে লাগিয়ে নেই, বলে প্রিয়নাথ আবার বারান্দা থেকে মাঠে নামে।
আচ্ছা রাখো, তোমার সাইনবোর্ডটা পরে লাগালেও চলবে। এখন দেখো, রাত্রির রান্না ত চাপাতে হবে। কালকের বাজারটাও করে রাখো। ফিরে এসে সব গোছগাছ করা যাবে। বিনোদবাবু বললেন।
হ্যাঁ চলুন, আমি আর প্রিয়নাথবাবু হাটটা ঘুরে আসি, বলে সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। যে-ভদ্রলোক তিনজন এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা এগিয়ে এসে বললেন, আমাদের অনুরোধটা একটু রাখবেন না? এ ত স্যার আমাদের এখানকার ব্যাপার। এ ত বরাবরই আমরা করে থাকি।
না, না, আপনারা যেটুকু করেছেন সেটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। আমরা এতজন আছি, ঠিক করে নিতে পারব। কোনো অসুবিধে হল বরং আপনাদের জানাব। আজ হাটের দিন, আপনাদের ত আবার কাজকর্ম আছে।
না। সে সব ত হয়া গেছে। কিন্তু কথাটা হইল, মোদের এই ক্রান্তি হাট কুনো বাইরের পার্টি, সে সরকারের হবা পারে, আবার, ধরেন কেনে প্রাইভেট পাটিও হবা পারে, সে কুনোদিন এ্যামন হয় নাই যে তারা নিজেরা রান্না করিবার ধরিসে। এ ত মোদের একখানা সুনাম-দুর্নামের বিষয়।
ভদ্রলোক প্রৌঢ়, রাজবংশী। তিনি যখন কথা বলছিলেন সুহাস খুব মন দিয়ে শুনছিল। অথবা যেন সুহাস তাকে দেখছিলও। এই একটা অনুজ্জ্বল, ডাল, বিস্কুট রঙের জামা, সুহাস এদের ভেতর আরো অনেককে পরতে দেখেছে। এগুলো কি এদিকে তৈরি হয়, নাকি, শস্তা? সুহাস ভদ্রলোককে যে তাকে কথাটা শেষ পর্যন্ত বলতে দেয় সে কি তার কথা বলাটাই দেখছিল বলে। তার এখানকার, এই আঞ্চলিক ভাষা তিনি কী ভাবে মেশাচ্ছেন ভদ্রলোকদের ভাষার সঙ্গে। একবারের জন্য সুহাসের মনে হয়, আজকে রাত্রির জন্য এঁদের আতিথেয়তা মেনে নিয়ে কাল থেকে নিজেদের বন্দবস্ত করে নেয়াই ভাল কি না। তাতে অকারণ টেনশন হত না। এরাও খুশি হতেন, তার অফিসের লোকজনও খুশিই হত–পয়সাটা বাচত। আর এটা বোধ হয় তার পক্ষে একটু বাড়াবাড়িও হচ্ছে। সুহাস কোনো নীতিবাগীশ কারণে ত আর এদের আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করছে না। তাকে ত সরকার টাকা দেয় খাওয়াদাওয়ার জন্য। সে-টাকাটা না নিয়ে ওদের কাছে খাওয়া যায়। কিন্তু অত হাঙ্গামা সে করবে কেন?