.
০০৪.
ঢোলের বদলে মাইক
প্রিয়নাথ ত এখন এই ঢোলাই দেওয়া বন্ধ রেখে, ফিরে গিয়ে, ঘরদোর গোছানো ঠিক আছে কি না দেখে সাইনবোর্ডটা টাঙিয়েও দিতে পারে। তার এই নতুন অফিসারটাকে সে যে এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নি। একেবারেই নতুন এসেছে, বিশেষ করে নাকি অপারেশন বর্গার জন্যই সরকার পাঠিয়েছে। কিন্তু সি-পি-এম নয়, নকশাল। আগেই নাকি নকশাল ছিল। তার পর অফিসার হয়েছে। জোতদার দেখলেই খেপে যায়। জোতদার নিজচাষ রেকর্ড করাতে চাইলেই বলে, হাত দেখি। হাতের কড়া গোনে। এখানকার ক্যাম্পে নিজেই থাকবে। কতজন গিয়ে বলেছে তাদের বাড়িতে থাকতে, চা বাগানের মালিকরা বলেছে বাগানের বাংলোতে থাকতে। এদিককার এইই রীতি। কিন্তু সাহেব কারো কথা শোনে নি। এখানে এসেই যদি শোনে ঢোলাই দেয়া হয় নি, তখন ত ধরা পড়ে যাবে–কোনো হাটেই কোনোদিন প্রিয়নাথ কাউকে ঢোলাই দিতে ডাকে নি। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।
আর দেরি করা কোনো কাজের কথা নয়। প্রিয়নাথ একবার আন্দাজের চেষ্টা করে মুদি বা গালামালের দোকানগুলো কোনদিকে হতে পারে। মিষ্টির দোকানের পাশের বড় দোকানটার বাইরে যেন টিনের বাণ্ডিল দেখে ছিল। সেখান থেকে একটা টিন চেয়ে নিয়ে এলে তাড়াতাড়ি সারা হাটে একবার পিটিয়ে ঘুরে আসতে পারে। প্রিয়নাথ বাইরের সেই দোকানটায় যেতে পিছন ফিরল।
কিন্তু হাট থেকে বেরবার মুখটাতে দেখে বা দিকের বড় উঁচু ডাঙাটায় মদেশিয়াদের একটা দল–একজন ঢোল বাজাচ্ছে, আর একদল মেয়ে হাত দিয়ে এ ওর কোমর ঘিরে নাচতে লেগেছে। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ একটু ভাবে যে এই সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে ওর কাছ থেকে ঢোলটা চাওয়া যায় কি না। তা হলে ত ছেলেটাকেই বলতে হবে ঢোলাই দিতে। তার মানেই পয়সাটা হাতছাড়া। কিন্তু যদি বলে সেটেলমেন্টের পিয়ন–তোমার ঢোলটা দাও, ঢোলাই দিয়ে ফেরত দেব। ওরা নিশ্চয়ই চা বাগানে কাজ করে। সুতরাং সেটেলমেন্টের পিয়নকে খুব একটা কেয়ার না-ও করতে পারে। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা, ওকে ত বোঝাতে হবে-তোমকো ঢোলঠো দোও, হাম ঢোলাই দেগা! ঢোলওয়ালা চাই না, কিন্তু তার ঢোলটা চাই–এ রকম একটা কঠিন কথা বোঝাতে অনেক হিন্দি বলতে হবে। আর অতগুলো মদেশিয়া মেয়ে অনেকসময় একসঙ্গে হেসে ওঠে। প্রিয়নাথ মুদির দোকানের খোঁজেই বেরল।
এখন যেন হাটটা এই রাস্তাতেও ছড়িয়ে-ছাপিয়ে পড়ছে। একবার উঁকি মেরে দেখে নিল তাদের জিপটা এসে গেছে কি না। তার পরই সেই মাড়োয়ারির দোকানের দিকে চলল। গিয়ে দেখল, তার আন্দাজ ঠিক নয়, বাইরের ওগুলো কেরোসিন তেলের ব্যারেল। দোকানটা মালের কেরোসিন ডিলার, শর্মার।
আচ্ছা এখানে মুদির দোকান কোন দিকে?
এই রাস্তা ধরে বেঁকে যান, ডান হাতিতে।
প্রিয়নাথ রাস্তা ধরে ডানহাতিতে বেঁকল। মুদির দোকান। অনেক টিন আছে। হাঁফ ছেড়ে প্রিয়নাথ।
দাদা, একটা টিন দিবেন!
কিসের? ডালডার না বিস্কুটের?
একটা হলেই হল।
ফুল সাইজ সাত টাকা, হাফ সাইজ চার টাকা।
অ্যাঁ? না, মানে আমি আবার ফেরত দিয়ে যাব।
ফেরত দিয়ে যাবেন? করবেন কী?
কাল থেকে ত এখানে হলকা ক্যাম্প বসিবে—
কিসের ক্যাম্প?
সেটেলমেন্টের
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা বলে দিল, ওসব আমাদের দরকার নেই। হবে না। প্রিয়নাথ একটু হকচকিয়ে যায়। সরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এরকম একটা দোকান চালাচ্ছে লোকটা হাটের মধ্যে আর এখানে জমিজমা করে নি? নাকি লোকটা মালিক নয়, কর্মচারী? প্রিয়নাথের একবার মনে হয় জিজ্ঞাসা করে, আপনাদের মালিক কে? সে পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারে না। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অগত্যা তাকে সিদ্ধান্ত করতেই হয় যে সাহেবকে বলবে ঢোলাই দেওয়া হয়েছে। তার পর যদি সাহেবের সন্দেহ হয়–তখন দেখা যাবে। এখন বরং সাইনবোর্ডটা টাঙিয়ে ঘরটা ঠিকঠাক করে নেয়া দরকার।
এই হাট কমিটির হাতে নাকি কোন কো-অপারেটিভের তিনটে ঘর ছিল–তার ভেতর দুটো ঘর ক্যাম্পের জন্য পাওয়া গেছে। প্রিয়নাথ এখন সেই ঘর খুঁজতে চলল। যেতে-যেতেই তার মনে হয় সে মিছিমিছি এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিল। সাহেবের কি আর-কোনো কাজ নেই যে এসেই জনে-জনে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করবে হাটে ঢোলাই হয়েছে কি না। সে ত তাও দু-জায়গায় সাইনবোর্ড পিটিয়ে চেঁচিয়েছে। মিষ্টির দোকানটাতেই জিজ্ঞাসা করা ভাল, হাট কমিটির ঘরটা কোথায়, ভেবে, দোকানটাতে ঢোকে। আর তখনই মাইকে ধীর, শান্ত, গম্ভীর গলায় শুনতে পায়, ভাগ্যের চাকা ত সব সময়ই ঘুরছে। আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। আমরা ভাগ্যের হাতে পুতুল। কিন্তু ভাগ্য ত সবসময় খারাপই হয় না। ভালও হয়। পুরুষের ভাগ্য দেবতারাও জানেন না। মেয়েদের ভাগ্যও দেবতারা জানেন না। কিন্তু কর্ম না করলে ত আপনি ভাগ্যের ফল পাবেন না। কর্ম আপনাকে করতেই হবে। পাঁচ টাকা নয়, দশ টাকা নয়, মাত্র এক টাকা দিয়ে লটারির একটা টিকিট কিনুন। প্রতি সপ্তাহে একবার খেলা। কে জানে, এবার হয়। ত আপনার টিকিটেই ফার্স্ট প্রাইজ উঠবে এক লক্ষ টাকা। এক টাকা দিয়ে এক লক্ষ টাকা। কিন্তু একটা টাকা দিয়ে টিকিটটা ত আপনাকে কাটতে হবে, আপনি ত আর অন্যের কাটা টিকিটে প্রাইজ পাবেন না। আসুন। এক টাকা দিয়ে একটা টিকিট কাটুন।