নিমকির তেলে তার হাতের আঙুল ভেজা। প্রিয়নাথ মাথায় মেখে নিল। তারপর দুই হাত ঘষল। সে বসেছে একেবারে রাস্তার পাশে–যারা চা খেয়েই সরে পড়ে, বড় জোর নিমকি খায় তারাই এখানে বসে কিংবা দাঁড়ায়। এর পরে মাঝখানের সারিতে যারা বসে তারা চা খায়, নিমকি খায়, জিলিপিও খায়। তাদের সামনেই খোলা চৌকিতে জিলিপির পাহাড়। আর পাশে বড় বড় টিনে চানাচুর। আর, যারা বড় বড় মিষ্টিটিষ্টি খাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে তারা সব বসেছে দোকানের একেবারে ভেতরে, সারি সারি টেবিল-চেয়ারে যে যত পারে ভেতরে সেঁদিয়ে। ভেতরের ঐ সব জায়গাতেই ত বড় বড় হাটে আসল বেচাকেনা সাব্যস্ত হয়। শুধু হাটের জিনিশ বেচাকেনাই নয়, আগামী বছর কোন জমি কে বেচবে, কে কিনবে, সে-সবের কথাবার্তাও এখান থেকেই শুরু হয়। কাল থেকে ক্যাম্প। কাল থেকেই লোকজন ত প্রিয়নাথকে নিয়ে যত পারে দোকানের ভেতরে ঢুকতে চাইবে। পারলে ওদিকের দেয়াল ভেঙে আরো ভেতরে নিয়ে যেতে চাইবে। কাল থেকে? তার ব্যাগটা আর সাইনবোর্ডটা হাতে তুলে নিয়ে আর-একবার দোকানটা দেখে ভাবে–এই ঢোলাইটা হয়ে গেলেই ত শুরু হবে, দাদা, দাদা। না, আজকে নয়। আজ ঢোলাইয়ের পর এখানে এসে, এখানে বসে, সবার সামনে সে আবার দুটো নিমকি ও এককাপ চা খেয়ে উঠে যাবে। হাটের লোকে দেখুক সেটেলমেন্টের পিয়ন নিজের পয়সাতেই চা-নিমকি খায়, খেতে পারে।
এবার প্রিয়নাথ ঝোলাটা কাঁধে আর সাইনবোর্ডটা হাতে ঝোলায়। তারপর রাস্তাটা কোনাকুনি পেরিয়ে হাটে ঢুকবার সময় রাস্তা থেকে একটা কাঠি কুড়িয়ে নেয়।
এদিকটায় ছাউনিঅলা দোকান। কোনো-কোনো ছাউনি ভামনির, একটা ছাউনি পেটানো টিনের, আর বেশির ভাগই প্লাস্টিকের চাদরের। ঐ দিয়ে মালপত্র বেঁধে নিয়ে এসেছে। ঐটাই মাথায় টাঙিয়েছে। এদের বেশিরভাগ দোকানেই জামাকাপড় আর গেঞ্জি-প্লাস্টিকের ঠোঙায় ভরা, আবার, কাগজের বাক্সও আছে। ঠিক পেছনেই খোলা বাজার। সেই ভোলা বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ কাঠিটা দিয়ে টিনের সাইনবোর্ডটাকে সামনে এনে পেটায়। কেমন একটা ঢ্যাপ ঢ্যাপ আওয়াজ হয়। তাই প্রিয়নাথ আবার পেটায়। এবার সামনের ও পাশের দোকানদাররা চোখ তুলে তাকায়। আগামীকল্য হইতে ক্রান্তিহাটের হাটখোলাতে সেটেলমেন্টের হলকা ক্যাম্প বসিবে। দলিলপত্রসহ সবাই যথা মৌজায় যথাসময়ে হাজির হইবেন। হইবেনটা বেশ টান দিয়ে শেষ করে প্রিয়নাথ। আবার হাটে। দু পা এগিয়ে তার মনে পড়ে অপারেশন বর্গার কথাটা বলা হল না। পরের জায়গায় বলবে। কিন্তু কিছুতেই তার মনে থাকতে চায় না। হলকা মানে জোতদারের ব্যাপার। কে তার জমিতে বর্গা করে তার লিস্টি সেটেলমেন্টের হবে কেন। প্রিয়নাথ জলপাইগুড়ি শহরের মাইল-সাত দক্ষিণে বিঘা পাঁচেক জমি কিনে আধিতে দিয়েছে বছর বার। বাড়ির ছ-মাসের ধানটা আসে ওখান থেকে। তার আধিয়ারও কি রেকর্ড করাবে নাকি।
কাটা কাপড়ের দোকানের সারির মাঝখান দিয়ে প্রিয়নাথ সোজা পশ্চিমে যাচ্ছিল। মাঝখানে এক চৌপত্তির পর ডাইনোয়ে মশলার দোকান। ওদিক থেকে একজন, বেঁটে-এক ঘোড়ায় চড়ে আসছিল। ঘোড়র ওপর বসেও নোকটার মাথা হাটের চালাগুলো পর্যন্ত পৌঁছয় না। হয়ত ফরেস্টের ভেতরে বা চরের খুব ভেতরে কোথাও থাকে। ঘোড়া ছাড়া যাতায়াতের উপায় নেই। প্রিয়নাথ সরে গিয়ে ঘোড়ার যাওয়ার পথ ছেড়ে দেয়। কিন্তু সরে দাঁড়ানোর পরই পাশ থেকে ঘোড়ার চেহারা দেখে প্রিয়নাথের আত্মসম্মানে লাগে। মনে হল এই ঘোড়াটারই উচিত ছিল তার জন্য পথ ছেড়ে দেয়া,নইলে প্রিয়নাথকে ত এর পর গরুর জন্যও পথ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং ঘোড়া তাকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই প্রিয়নাথ তার হলকা ক্যাম্প দিয়ে ঘোড়ার পেছনে এক ধাক্কা মেরে পথে নামে। সেই ধাক্কাতেই ঘোড়ার কোমর থেকে পেছনটা একবার টাল খায় আর পেছনের ডান পা, যেটা প্রিয়নাথের দিকে, হাঁটুতে ভাজ হয়ে দুমড়ে পড়ে প্রায়, যেন বৈশাখ মাসের ঝড়ের মুখে হাটের চালাঘর। প্রিয়নাথ : এক লাফে আবার রাস্তার পাশে সরে যায়, পাছে ঘোড়াটা দুমড়ে-মুচড়ে তারই ওপর ভেঙে পড়ে। আর ঘোড়াটা তখন তাকে ছাড়িয়ে বা পাশের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। ধুত, বলে প্রিয়নাথ পথে নামতেনামতে দেখে ঘোড়ায় চড়া লোকটি একটা লাঠির মাথায় বাধা ঝোলা এগিয়ে দিচ্ছে। ঘোড়া থেকে না নেমেই হাট করা।
মশলার দোকানগুলোর শেষে হাটটা ডাইনে বায়ে ছড়িয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ আবার কাঠি দিয়ে তার সাইনবোর্ড পেটায়। আওয়াজ এত ঢ্যাপ ঢ্যাপ যে প্রিয়নাথকেও একবার সাইনবোর্ডটা তুলে টিনটা পরখ করতে হয়। যেন নিজের কীর্তির দিকে তাকিয়ে দেবে। হাটে ঢোলাই দেওয়ার কাজ হলকার সাইনবোর্ড পিটিয়ে সেরে-সেরে সে ঢিনাটকে প্রায় ফাটিয়ে এনেছে। পাছে টিনটি আরো ফেটে যায় এই ভয়ে প্রিয়নাথ কাঠিটা জোরে মারতে পারে না। একবার ডাইনোয়ে তাকিয়ে, টিনটাতে ছোট করে একটা কাঠি মেরে, মুখের কাছে হাত তুলে চেঁচাল, আগামীকল্য হইতে ক্রান্তিহাটে সেটেলমেন্টের হলকা ক্যাম্প বসিবে। আপনার দলে দলে যোগদান দিন।
হঠাৎ প্রিয়নাথের চেঁচানো শুনে পান আর শুকনো তামাকের দোকানদাররা মুখ তুলে তাকায়। হাটে ত নানারকম লোকই আসে। পুরনো হাটে ভিখিরি-পাগল এরাও চেনা হয়ে যায়। দোকানদাররা পাছে তাকে নতুন ভিখিরি বা পাগল ভাবে এই ভয়ে প্রিয়নাথ তার সাইনবোর্ডের লেখা-দিকটা ঘুরিয়ে দিল। কাঁধে ঝোলা আর সামনে সাইনবোর্ডলোকজনের এতে আরো সন্দেহ হওয়ার কথা। তাই প্রিয়নাথকে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য সাইনবোর্ডটা আবারও দেখতে হয়। না, সরকারি চিহ্ন আকা আছে, সত্যমেব জয়তে, মুছে গেলেও বোঝা যায়। সত্যমেব জয়তে নিয়ে ত আর কেউ পাগলামি করে না।