বাঘারু জানে না, ব্যারেজটা কতখানি লম্বা। সে শুনেছে বটে ব্যারেজ শেষ হয়নি কিন্তু কোন পর্যন্ত হলে শেষ তা ত আর সে জানে না। এই বাতাসের ধাক্কা সামলাতে-সামলাতে এই আবছায়া ঠেলে এগতে-এগতে তার মনে হয় সে অনেকদূর এসে পড়েছে। সে আর এগবার সাহস পায় না। বাঘারু সামনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দাঁড়ানোর পর তার দুই পা ফাঁক করে দেয়–আবার সেই প্রস্তুতিতে। বাঘারুকে মাথাটা একটু পেছনে হেলাতে হয় বাতাসের বেগ সামলাতে বা সামনের দূরত্বের আন্দাজ পেতে।
মাদারি তার শরীরের ভেতর থেকে চিৎকার করে, এইঠে শেষ? এই ব্যারেজখান?
না জানো।
মাদারি শুনতে পায় না। সে বাঘারুর বা পা থেকে মাথাটা বের করে এনে আবার চিৎকার করে, এইঠে শেষ? এই ব্যারেজখান?
এবার বাঘারু মাদারিকে পেছন থেকে সামনে টেনে আনে–মোক জোর করি ধরি থাক–ক্যানং বাতাস!
মাদারি ঘারুকে জড়িয়ে ধরে কিন্তু বেড় পায় না। না-পেয়ে ছোট-ছোট হাতদুটো বাঘারুর শরীরে আরো গেঁথে দেয়। তার পর বা হাতটা আলগা করে বাঘারুর পেছনে সেই বাঘের থাবার অসমতলটা খোঁজে, যেখানে হাতটা আটকানো যেতে পারে। মাদারি বাঘারুকে চিনে নিয়েছে তিস্তা বদলে দেয়া এই অজ্ঞাতপূর্ব ব্যারেজের ওপর এই নিশীথিনীতে একসঙ্গে থাকলে যে-দ্রুততায় চিনে নেয়া যায়, চিনে নিচ্ছে। বাঘারু মাদারিকে দুই হাতে তার শরীরে জড়িয়ে ধরে।
মাদারি ঘাড় হেলিয়ে বাঘারুকে জিজ্ঞাসা করে, এইঠে শেষ? এই ব্যারেজখান?
না জানো।
এইঠে তিস্তা? তিস্তা নদী?
কথাটার জবাব দেবার জন্যেই হোক অথবা নিজেই সে তিস্তাকে খুঁজছে বলেই হোক, বাঘারু ডাইনে বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে।
না জানো।
তোমরালা তিস্তা নদীখান্ না-চেনেন?
না চিনো।
এইঠে তিস্তা নদীখান তুলি দিছে?
না জানো।
নতুন নদী বানাইছে? এইঠে?
না জানো।
তোমরালা এইঠেকার মানষি না হন?
বাঘারু জবাব দেয় না।
জলুশত্ আসিছেন?
মোর কুনো মিছিল নাই। বাঘারু হাতদুটো মাদারির মাথার চুলের ওপর রাখে আর মাদারি এই মিছিলহীন ও নদীহীন সর্বহারা মানুষটিকে মমতায় আরো জড়িয়ে ধরে। তারপর আধা কৌতুকে জিজ্ঞাসা করে, তোমরালা কি মোর নাখান হারি (হারিয়ে) গিছেন?
বাঘারু খুক করে হেসে ফেলে।
পেছনে পুলিশের চিৎকার শোনা যায়, এই চইল্যা আইস, টাইম হইয়া গিছে, চইল্যা আইস।
মাদারি আর বাঘারুর ঘুরে দেখে পুলিশ টর্চ ফেলে তাদের ফিরে যেতে বলছে। তারা ফিরে আসতে থাকে।
পুলিশটি তাদের ডেকে ও তাদের ফিরে আসতে দেখেই চলে গিয়েছিল। মঞ্চের তলার পর্দা ঠেলে বাঘারু আর মাদারি যখন সেই তীব্র আলোকিত, ছোট বালুভূমিতে ঢোকে তখন সেখানে আর-কেউ ছিল না। মাদারি বাঘারুকে ছেড়ে দেয়, বাঘারু মাদারির মুঠো আলগা করে দেয়। মাদারি এক পায়ে ভর দিয়ে নাচতে নাচতে সেই বালুভূমি পার হয়। পেছন ফিরে বাঘারুকে ডাকে, আইসেন। শাদা বালির ওপর তাদের ছায়াদুটো ক্রমেই লম্বা হতে থাকে, শেষে সেই শাদা মাঠের সবটুকু জুড়েই ওদের ছায়াদুটো। যেই তারা আলোর স্তম্ভটা পার হয় অত দীর্ঘ ছায়াদুটো নিমেষে মুছে যায়। ওখানে বাঁশের বেড়া আছে। বাঘারু ও মাদারি সেটা টপকে আপলাদের ভেতর ঢুকবে। তাপলাদে এখন জঙ্গলময় জোনাকি। মঞ্চের নীচ থেকে ঐ ফ্লাড-লাইটগুলো পেরিয়ে বাঘারু-মাদারিকে বা সে-সব কিছু দেখা যায় না।
.
আমরা বাঘারু-মাদারিকে আর অনুসরণ করব না।
বাঘারু তিস্তাপার ও আপলচাঁদ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মাদারিও তার সঙ্গে যাচ্ছে। যে কারণে তিস্তাপার ও ও আপলাদের শালবন উৎপাটিত হবে–সেই কারণেই বাঘারু উৎপাটিত হয়ে গেল। যে কারণে তিস্তাপার ও আপলাদের হরিণের দল, হাতির পাল, পাখির ঝাক, সাপখোপ চলে যাবে–সেই কারণেই। বাঘারু চলে যায়। তার ত শুধু একটা শরীর আছে। সেই শরীর এই নতুন তিস্তাপারে, নতুন ফরেস্টে বাঁচবে না। এই নদীবন্ধন, এই ব্যারেজ, দেশের অর্থনীতি বদলে দেবে, উৎপাদন বাড়াবে। বাঘারুর কোনো অর্থনীতি নেই। বাঘারুর কোনো উৎপাদনও নেই। বাঘারু এই ব্যারেজকে, এই অর্থনীতি ও এই উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করল। বাঘারু কিছু-কিছু কথা বলতে পারে বটে কিন্তু প্রত্যাখ্যানের ভাষা তার। জানা নেই। তার একটা শরীর আছে। সেই শরীর দিয়ে সে প্রত্যাখ্যান করল।
সে এখন সারারাত ধরে এই ফরেস্ট পেরবে–যেখানে সে জন্মেছিল। দুটো-একটা রাস্তাও পেরবে। কাল সকালে আবার ফরেস্ট পেরবে। দুটো-একটা হাটগঞ্জও পেরবে। কখনো মাদারির ঘুম পাবে। বাঘারু মাদারিকে বুকে তুলে নেবে। কখনো মাদারি বাঘারুর আগে-আগে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে-দিয়ে রাস্তা বানাবে। মাদারিও ত আর-এক ফরেস্টের সন্তান। এরকম হাঁটতে-হাঁটতে যখন বাঘারুর মনে হবে নতুন একটা ফরেস্ট, নতুন একটা নদী খুঁজে পেল, তখন বাঘারু থামবে। সেই নতুন নদী, নতুন ফরেস্টটা বাঘারু এই শরীর দিয়েই চিনবে। বাঘারু জানে না-মাদারি কে, সে কোথায় থাকে, সে কেমন করে ফেরত যাবে। কিন্তু পাঠক ত জানেন–মাদারি কে, সে কোথায় থাকত। এখন, সারারাত, সারা দিন ফরেস্টের পর ফরেস্ট, নদীর পর নদী, হাটের পর হাট পেরতে-পেরতে তাদের কত কথা হবে, তারা দুজন-দুজনকে কত জানবে, তাদের কতবার ঘুম পাবে আর কতবার জাগরণ ঘটবে, তারা দুজন দুজনের পক্ষে কত অপরিহার্য হয়ে উঠবে। সে ত আর-এক স্বতন্ত্র বৃত্তান্ত।