কিন্তু তিস্তাপরের বৃত্তান্ত যে-এমন আমূল বদলে যাবে–তাতে বাঘারু, মাদারির মা ও মাদারির কী হবে?
তারা কি গয়ানাথ রাধাবল্লভ-নিতাইদের মত নতুন তিস্তার সঙ্গে, নতুন ফরেস্টের সঙ্গে, নতুন চাষবাসের সঙ্গে মিলেমিশে যাবে? নাকি, তারা ঐ গণ্ডার, হরিণ, হাতির পাল, বানরের দল, পাখি, সাপদের মত এই বন বদলাবে, এই নদীকে ছেড়ে অন্য কোনো অপরিবর্তিত নদী-তীর খুঁজবে?
নৃতত্ত্বে অবিশ্যি এর একটা জবাব আছে। বানর থেকে মানুষ হয়ে ওঠার পাঁচ লক্ষ বছর ধরে যে-সব মানবগোষ্ঠী নিজেদের নিয়ত বদলাতে বদলাতে এসেছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলি গোষ্ঠী সেই আদি মানবসমাজ থেকে আধুনিক মানবসমাজের রূপান্তরের মাত্র হাজার পাঁচেক বছর আর তাল রাখতে পারেনি। তারা সেই পাঁচ হাজার বছরের ভেতরে কেননা একটা স্তরে ঠেকে গেছে। যেমন, আন্দামান-নিকোবরের জারোয়া, উঙ্গি, সেনটিনেল বা কেরালার গুহামানবরা। তেমনি নদী-অরণ্য এই সব প্রাকৃতিক বিষয় বদলে দিয়ে যে-নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে বাঘারু, মাদারির মা ও মাদারি তাল রাখতে পারেনি, তারা ঐ আদি একটা স্তরে আটকে গেছে। এদের জন্যে অর্থনীতিতে একটা নতুন নামও তৈরি করা যায়, উৎপাদন ব্যবস্থার আদিবাসী-উপজাতি। কিন্তু এরকম নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব বা তুলনা দিয়ে বাঘারুসমস্যা সামলানো যাবে না। অবিশ্যি সমস্যা বলে মেনে নিলে তবে ত সমাধানের কথা আসে। এ বৃত্তান্তের যে-কোনো পাঠকই অনুমান করতে পারবেন যে এখন নদী যতই বদলাক, ফরেস্ট যতই বদলাকবাঘারু, মাদারির মা ও মাদারি বদলাবে না। বদলের আগেই আমরা জানি কী বদলাবে আর কী বদলাবে না। কিন্তু নৃতত্ত্বে কি এমন কোনো পদ্ধতি আছে যাতে এরকম আগে থেকে বলা যায় কোন্-কোন্ গোষ্ঠী তাল মেলাতে পারবে না, ও আটকে যাবে? মাদারির মা আর বাঘারু ত পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থারও কেউ ছিল না। তাদের তাই আটকে থাকারও কোনা জায়গা নেই। আর, পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থায় তারা কোথাও ছিল না বলেই নতুন ব্যবস্থাতেও তারা কোথাও থাকবে না। মাদারির মা যেখানে আছে, সেখানেই থাকতে-থাকতে ঘাসপাতার সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু বাঘারু ও মাদারির কী হবে? এরা দুজনই শেষ পর্যন্ত এই বৃত্তান্তে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে।
সেদিন বাঘারু স্বাধীন পা ফেলে উদ্বোধন মঞ্চের দিকে হেঁটে আসছিল। স্বাধীন–কারণ, গয়ানাথ তাকে বলেনি ঐ উৎসবে যেতে। স্বাধীন-কারণ, সে তার শরীরে এক দায় বোধ করেছিল এই নদীর ভেতর গজিয়ে ওঠা পাহাড়টার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী তা বোঝার। সে এক ঝুঁকিতে গয়ানাথের ঝাণ্ডা ফেলে দিয়ে নদীর ব্যারেজ ও ব্যারেজের প্যান্ডেলের দিকে এগয়। আপলচাঁদ ফরেস্ট ও তিস্তা নদীতে ত এমন কিছু ঘটতে পারে না যা বাঘারুর শরীরনিরপেক্ষ। পাখিদেরও এরকমই স্বভাব। কোনো এক মহীরুহের ডালে-ডালে, দেলে-খোদলে, কত বিচিত্র জায়গায় কত রকম ভাবে তারা বাসা বাধে, জন্ম-জন্মান্তর ধরে সে বাসায় থাকে। একটা পাখির জীবন একটা মহীরুহের তুলনায় ক-দিনের। সেই মহীরুহকে পাখিরা পুরুষানুক্রমিক চেনে। তারপর মহীরুহটি উৎপাটিত হলেও পাখিরা তাদের অভ্যেস ছাড়তে পারে না। তারা আকাশের সেই শূন্যতাটাকেই ডালপালা ভেবে নেয়, উড়ে-উড়ে এসে বসতে চায়। সেখানে যে সত্যি আর গাছটা নেই এটা বুঝতে সেই পাখিগুলোকে দু-এক বর্ষায় ভিজতেই হয়। শরীর দিয়ে তারা জেনে নেয়–পুরনো আশ্রয় আর নেই। তখন নতুন গাছ খোঁজে।
বাঘারু সেভাবেই এগচ্ছিল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। যেন সে আছে আর ব্যারেজ আছে আর ব্যারেজের প্যান্ডেল আছে।
এখান থেকে মঞ্চে পৌঁছুবার কোনো রাস্তা ছিল না। ভি-আই-পিদের গাড়ি রাখার জায়গার পেছনে মিছিলগুলোকে বসাবার ব্যবস্থা একেবারে ফরেস্টের ভেতর। জঙ্গল বহুদূর পর্যন্ত পরিষ্কার করে দেয়া। হয়েছে। বাঘারু সোজা আসছিল। তার পা ফেলায় মুক্তির ছন্দও ছিল হয়তোর কাঁধে ঝাণ্ডা নেই, হাত-পা ঝাড়া। আপাদমস্তক খোলামেলা। অথচ অতটা নগ্নতাতেও দারিদ্র্য থেকে সে সম্পূর্ণ মুক্ত। বাঘারুকে এখন শালপ্রাংশু বলা চলে। সোজা হাঁটতে হাঁটতে এসে বাঘারু বাঁশের বেড়ায় ঠেকে যায়। ঠেকে গিয়ে বেড়াটা টপকাতে নেয়।
তখন এক পুলিশ এসে তাকে বোঝায় এ-বেড়াটা টপকাতে দেয়া যাবে না। পুলিশটি খুব ভদ্রতার সঙ্গে বাঘারুকে দেখিয়ে দেয় এবং এগিয়েও দেয়। বাঘারুকে এখন ডাইনে ঘুরে এই বাঁশের বেড়াটার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে-যেতে আবার ফরেস্টের ভেতর ঢুকতে হবে। সেখান থেকেই বক্তৃতা শুনতে হবে। বেড়ার এক পাশে পুলিশ, এক পাশে বাঘারু–একই সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে যায়। তারপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পুলিশ আঙুল তুললে দেখাই যায়–ফরেস্টের ভেতর মানুষের অগুনতি মাথা। বাকি। পথটুকু বাঘারু একাই যায়। এক জায়গায় বেড়াটা বা দিকে ঘুরেছে। সেখান থেকে লোকজন বসেছে।
বাঘারু প্রথম সারিতেই ঢুকতে যায়।
বাঘারু যেদিক থেকে জনসভায় ঢুকছিল সেদিক থেকে আর-কেউই ঢোকেনি। মঞ্চ থেকে কেউ যদি নেমে এই সভার লোকজনের কাছে আসে, তাকেও ত প্রথম সারিতেই আসতে হবে।
কিন্তু প্রথম সারি ত দূরের কথা ততক্ষণে ত সভার সেই জায়গা মিছিলে-মিছিলে ভরে গেছে। সব মিছিলই এই তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনে সরকারকে জিন্দাবাদ দিতে এসেছে, কিন্তু, প্রত্যেকটা জায়গার মিছিলকে ত আলাদা-আলাদাই রাখতে হবে, থাকতে হবে। এক জায়গার মিছিলের সঙ্গে যদি আর-একটা জায়গার মিছিল মিশে যায় তা হলে ত সবাই হারিয়ে যাবে, একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা হবে। ফলে, এক-একটা জায়গার মিছিল এক-একটা জায়গায় গায়ে-গা লাগিয়ে, ঘঁটুতে হাঁটু লাগিয়ে বসে আছে প্রায় দেয়ালের মত। বাঘারু ঐ বেড়া ধরে এসে ঐ দেয়ালের ভেতর ঢুকতে যায়। তাকে তাই ঢুকতে হবে, কারণ, বাঁশের সেই বেড়া ওখানেই বায়ে বেঁকেছে আর বাঘারু ত বেড়া ধরেই এগচ্ছে। কিন্তু বাঘারু ঢুকবেই বা কী করে, ঢুকতে দেবেই বা কে? তাকে সেটা বুঝতে হয়, ধাক্কা খেতে-খেতে। নানা ভাষায় তাকে একটা কথাই শুনতে হয়, পেছনে যাও, পেছনে যাও, নিজের জায়গায় যাও, নিজের জায়গায় যাও। তাদের সবার বুকে ব্যাজ। তারা বাঘারুর ব্যাজহীন বুকের দিকে তাকায়। বাঘারুর বুকে ব্যাজ লাগানোর মত কাপড় নেই। কেউ রাগ করে তাকে বলে না। কেউ-কেউ ত সহানুভূতির সঙ্গেই তাকে রাস্তা দেখিয়ে দেয়। কিন্তু সবাইই এব্যাপারে প্রায় রাতে গায়ের পাহারাদারদের মত সতর্ক ও সাবধান যে, তাদের মিছিলের ভেতর যেন অন্য কেউ ঢুকে না পড়ে। এই কারণে বাঘারুকে ক্রমেই পেছিয়ে যেতে হয়, ক্রমেই সরে যেতে হয়, ক্রমেই দূরে যেতে হয়।