তিস্তা ব্যারেজের ফলে তিস্তার সঙ্গে গয়ানাথের সহবাসের রীতিনীতি সবচেয়ে বেশি বদলে যাবে। সে পুরনো মামলাগুলির কিছু জিতবে, কিছু হারবে। নতুন মামলাও কিছু করতে পারে। কিন্তু সে-ই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি অভ্রান্ত বুঝে যাবেব্যারেজের অর্থ কী? ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ভাগের মামলায় সে জিতলেও পাবে এক চিলতে জমি আর কয়েকটা শালগাছ। আর তিস্তা ব্যারেজের ফলে সে পাবে এক জমিতে তিন ফসল। ব্যারেজের নিশ্চিত জল, ব্যারেজের ফলে বন্যার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি, কেমিক্যাল সার আর ট্র্যাক্টার-সেই তিনটি ফসল খোলানে তুলে দিল বলে। গয়ানাথ পাওয়ার টিলার কিনে ভাড়া খাটাবে। গয়ানাথের গাই-বলদ কমে আসবে, জমিও হয়ত একটু কমে আসবে, বাঘারুও কমে আসবে কিন্তু ফলন বাড়বে, বিক্রি বাড়বে, লাভ বাড়বে।
আর, এই ব্যারেজের ফলেই গয়ানাথের কত কাছাকাছি চলে আসবে রাধাবল্লভদের কৃষক সমিতি। গয়ানাথদের সঙ্গে রাধাবল্লভদের ঝগড়া-মারামারি ছিল খাশজমির দখল নিয়ে। পুরনো তিস্তায়, এই বৃত্তান্তের তিস্তায়, ছিল সম্পত্তির জোতদারি। নতুন তিস্তায়, এই বৃত্তান্তের পরের তিস্তায়, শুরু হবে ফলনের জোতদারি। সম্পত্তির জোতদারিতে রাধাবল্লভদের সঙ্গে গয়ানাথদের সংঘাত ছিল। ফলনের জোতদারিতে রাধাবল্লভরা আর গয়ানাথরা ত সহকর্মী। গয়ানাথের পাওয়ারটিলার ছাড়া রাধাবল্লভদের চলবে না। আবার গয়ানাথের নিজের জমিতেও তিন-চারটি ফসল ফলবে, কৃষক সমিতির ভেস্টজমিতেও তিন-চারটি ফসল ফলবে। গয়ানাথ আর কৃষক সমিতি একসঙ্গে তখন ন্যাশন্যাল হাইওয়ের ওপর বসে–রাস্তা রোকো আর জেল ভরো আন্দোলন করবে। আন্দোলনের যে-সব কায়দা রাধাবল্লভদের কৃষক সমিতির জানা আছে, সেই সব কায়দা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে কৃষিপণ্যের ন্যায্য দর আদায় করার জন্যে গয়ানাথ আর কৃষক সমিতি মিলে আন্দোলন করবে-যেমন করছে উত্তরপ্রদেশে, যেমন করছে মহারাষ্ট্রের খেতকারীরা।
ব্যারেজের ফলে তিস্তাপারের ফরেস্ট বদলে যাবে, আপলচাঁদ বদলে যাবে। এসব ফরেস্ট ত মানুষের পরিকল্পনার ফলে তৈরি হয়নি। প্রচুর প্রচুর বৃষ্টিপাতে আর তিস্তার পলিতে এই তরাই-ডুয়ার্স সেই কবে থেকে ত এমন ঘন বন হয়ে আছে। যত ঘন হয়েছে, তত লম্বা-লম্বা গাছ হয়েছে। এক-একটা শাল, সেগুন, অর্জুন, খয়ের, লাম্পাতি গাছ দশকের পর দশক ধরে বেড়ে উঠেছে। আর সেই ভাবে বড় হতে-হতে স্থায়ী হতে-হতে এই পর্ণমোচী অরণ্য হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক। তা থেকে গাছ কেটে বিক্রি করা হয়েছে। দেশ-দেশান্তরে এখানকার শালগাছের সুখ্যাতি রটেছে। কিছু নতুন গাছ লাগানোও হয়েছে নিশ্চয়ই! কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাই ত হয়েছে মাত্র চল্লিশ বছর। শালগাছের একটা বন তৈরি করতে চল্লিশ বছর আর কতটুকু সময়।
ব্যারেজ জল দেবে, ব্যারেজ বন্যা ঠেকাবে–তা হলে এই সব হাজার বছরের পরমায়ুওয়ালা গাছ নিয়ে কী হবে? এ-সব গাছ উৎপাটিত হয়ে যাবে–তার জায়গায় নতুন গাছ বোনা হবে। সে-সব গাছ অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বাড়ে, তাড়াতাড়ি পাকে, তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়। ইউক্যালিপটাস হয়ত এসব বৃষ্টি-বাদলের জায়গায় তত ভাল হবে না। কিন্তু অন্য কোনো গাছ আবিষ্কার হবে-নরম গাছ। সে-গাছ থেকে ত স্থানীয় কোনো শিল্পও তৈরি হতে পারে।
বন বদলালে জীবজন্তু বদলে যাবে। হরিণ যদি তার খাবারযোগ্য ঘাস না পায়, তার নাকে যদি অভ্যস্ত গন্ধ না আসে, সে যদি এবনভূমিতে নিজেকে মিশিয়ে দেবার কোনো আবরণ না পায়, তা হলে, সে এখানে থাকবে কী করে। গণ্ডারের যদি ছায়া না জোটে, ভেজা পচা পাতা না জোটে, গড়াবার মত কাদা না জোটে তা হলে সে তার উদাসীন পা ফেলে-ফেলে কোনো এক দিকে হেঁটে চলে যাবে। হাতিরা দল বেঁধে চলাফেরা করে। শিশু বয়সে দলের সঙ্গে সঙ্গে থেকে শেখে পাহাড়ের কোন পথ দিয়ে নামতে হয়, কোন নদীর পাড় ধরে-ধরে এগতে হয়, কোথায় নদী পেরতে হয়, কোন জায়গায় পাওয়া যাবে স্বাদ চালতার বন, কোথায় আছে বড়বড় কলাগাছ। তারপর নিজে জোয়ান হয়ে তার দলকে সেই পুরুষানুক্রমিক পথেই নিয়ে আসে। কিন্তু এই বনই যদি না থাকে–হ্যাঁতির পাল কী করে নিজে পথ নির্ণয় করবে। তা ছাড়াও সেই নতুন বনের নতুন গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে, দ্রুত বিক্রি হয়। হাতির পালকে ত আর সেবনে ঢুকতে দেয়া যায় না। একটা শালগাছের ডাল ভাঙলে আর-একটা ডাল গজাবে। কিন্তু এ-সব গাছের ডাল ভাঙলে ত আর্থিক ক্ষতি! নগদ ক্ষতি! সেই নতুন বনে হাতির পাল পথ বদলাবে।
তিস্তাপারের এই সব বনে বানর খুব বেশি। এত ঘন বনে, এত উঁচু-উঁচু গাছে আর এত জমাট জঙ্গলে (আন্ডারগ্রোথ) বানরদের সব দিক থেকেই সুবিধে। তারা একটা এলাকায় গাছ থেকে গাছে চলে যেতে পারে অনায়াসে। গাছেরও খেতে পারে, তলারও কুড়োতে পারে। পাখি আর জন্তু-জানোয়ারদের সঙ্গে তাদের নানা রকম খেলাও চলে। কিন্তু সেই নতুন ফরেস্টে বন ত এত ঘন হবে না–ফরেস্টেরই প্রয়োজনে। সেবনে এই জঙ্গলও হয়ত থাকবে না–ফরেস্টেরই প্রয়োজনে। সেই নতুন বনে যে-গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠবে আর দ্রুত বিক্রি হবে সেগুলোর ডালপালা এতই দামি যে বানরদের সেখানে ছেড়ে দেয়া যায় না!
এই সব ফরেস্টে অজস্র পাখি আছে। নতুন পাখি আসে কি না কে জানে কিন্তু পুরনো পাখিদেরই এক বিশাল পৃথিবী তৈরি হয়ে আছে বড় বড় গাছের সুযোগে। আর ঘন জঙ্গলের সুযোগে আছে নানা ধরনের সাপ, প্রধানত পাইথন। এদের এই বন ছাড়তে হবে।