কিন্তু এ-নিয়ে গৌরব করারও কিছু নেই। মাদারির মায়ের দারিদ্র্যের মধ্যে ত কোনো গৌরব নেই, বড় বেশি অপমান আছে।
সেই অপমানের বিচ্ছিন্নতাকে বিদ্রোহের বিচ্ছিন্নতা বলে ভাবার মধ্যে, তার সাতকাহন বৃত্তান্ত রচনার মধ্যে, মিথ্যা কিছু থেকেই যায়। ভারতবর্ষে যারা কালিকলম ব্যবহার করতে জানে, আমাদের মত, তারা জানে না ভারতবর্ষের দরিদ্রতম ছ-সাত কোটির কথা কোন অক্ষরে লেখা যায়। তাই অক্ষরজ্ঞানহীন এই বৃত্তান্ত যত লেখা হবে, ততই মিথ্যা হবে—সে কহে বিস্তার মিছা, যে কহে বিস্তর।
এ বৃত্তান্ত তাই এখানেই, এমনই একটা যোগ্য জায়গায়, শেষ হোক।
মাদারির মা তার পাতার ঘরে রাত্রির বাকি কয়েক ঘণ্টা শেষপুত্রহীন কাটাক।
৭. পরিশিষ্ট – এই বৃত্তান্তরচনার যুক্তি ও বৃত্তান্তসমাপ্তির কারণ
এই বৃত্তান্তরচনার যুক্তি ও বৃত্তান্তসমাপ্তির কারণ
তিস্তাপারের বৃত্তান্ত শেষ হয়ে গেছে।
পাহাড় থেকে সমতলে নামার পর তিস্তার দৈর্ঘ্য ত মাত্র কয়েক মাইল। তাও আবার ভারতীয় ইউনিয়ন আর বাংলাদেশের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই কয়েক মাইলের মধ্যেই জোতপর্ব, বনপর্ব, চরপর্ব, ফরেস্টের বৃক্ষপর্ব, মিটিং-মিছিলপর্ব, তিস্তা ব্যারেজ পর্ব এই সব নানা ভাগ আছে। এগুলো আসলে নানা চিহ্নও ত বটে। এই সব চিহ্ন রেখে-রেখেই একটা নদী উপন্যাসের ভেতর দিয়ে দিয়ে বয়ে যায়। এই সব চিহ্ন দেখে-দেখেই আমরা উপন্যাসের ভেতরে প্রবহমাণ একটা নদীকে চিনে নেই।
সেই আদি পর্বের লোকরা অনেকেই অন্ত্যপর্বে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। আদিপর্বে তিস্তার জলপ্রান্তর আপলচাঁদ ফরেস্টের ভেতর যে-গাজোলডোবা গ্রামে প্রথম এবৃত্তান্তে দেখা গিয়েছিল, ঘটনাক্রমে সেই গাজোলডোবাতে সেই আপলাদের ভেতরই তিস্তার ভেতর মৈনাকের মাথা, মানুষের তৈরি মৈনাকের মাথা, জেগে উঠেছে–তিস্তা ব্যারেজ। এতে সত্যি সত্যি যেন একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। একটি বৃত্তান্তের সমাপ্তি ঘটল।
বাস্তবে কিন্তু তেমনটি হয়নি। এ বৃত্তান্ত লিখবার সময় জুড়ে তিস্তা ব্যারেজের কাজ চলেছে। এখনো সেকাজ শেষ হয়নি। এবৃত্তান্তে যখন প্রথম গাজোলেডোবা গ্রামে তিস্তার পাড়ে সার্ভের কথা লেখা হয়েছিল, তখন জানাও ছিল না–ঐ গাজোলডোবাতেই তিস্তা ব্যারেজের প্রধান ঘাটি হবে। এ বৃত্তান্তে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনের কথা যখন লেখা হয়েছিল–তখন উদ্বোধন হবে এমন কথা ওঠেই নি। কিন্তু কিছু দিন পরে এই বৃত্তান্তের বর্ণনানুযায়ীই একটি উদ্বোধন-অনুষ্ঠান ঘটেছিল। এবৃত্তান্তে কেননা ব্যক্তি বা ঘটনাকে বা ইতিহাসকে নথিভুক্ত করা হয়নি। বরং বারবার এই বৃত্তান্ত থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনো ঘটনা বাইরে কোথাও ঘটে গেছে, হয়ত ইতিহাসও হয়ে গেছে। উপন্যাসের মতই এই সব ব্যারেজও ত একটা সৃষ্টিকর্ম। তাই সৃষ্টির যুক্তিতে এ দুই ঘটনা, এই ব্যারেজ আর এই বৃত্তান্ত, একই জায়গায় ফিরে-ফিরে আসছে। আসছেই যখন, তখন সেইখানে ফিরে আসার আগে এ-বৃত্তান্ত শেষ করা যেত না।
এ বৃত্তান্ত শেষ হওয়ার পর এর আর নতুন কোনো পর্বান্তরও সম্ভব নয়। ব্যারেজ উদ্বোধনের সঙ্গে-সঙ্গে এবৃত্তান্তের তিস্তা ইতিহাস হয়ে গেল। এখন আর তিস্তা সেই পুরনো তিস্তা থাকল না। এখন প্রকৃতির সেই নদীর পুনর্জন্ম ঘটবে মানুষের হাতে। হিমালয়ের তুষারগলা জল আর মৌসুমি মেঘের বৃষ্টিধারায় তিস্তার জল যতই বেড়ে উঠুক, তা বয়ে যাবে মানুষের নির্দেশিত খাতে, নির্দেশিত গতিতে। তখন চর জেগে উঠবে মানুষের ইচ্ছায়। সে-চরকে সবুজ করে দিয়ে নদী তার পাশ দিয়ে অনুগত বয়ে যাবে–মানুষের তৈরি নিসর্গে। তিস্তা নিয়ে কোনো উপকথা পুরুষানুক্রমে বয়ে আসবে না। তিস্তা ব্যারেজের পর তিস্তার প্রাকৃতিক জীবন শেষ, এখন সে এক মানবিক নদী। তিস্তা তার মানবিক ইতিহাসের পর্বে ঢুকবে। তিস্তাবুড়ি, কুমারী হয়ে উঠবে।
এই তিস্তাপারের বৃত্তান্ত সেই প্রাকৃতিক তিস্তার সঙ্গে মানুষজনের সহবাসের রীতিনীতির বৃত্তান্ত। গয়ানাথের সঙ্গে তিস্তার সহবাসের এক রকম রীতিনীতি, নিতাইদের সঙ্গে আর-এক রকম আর সীমান্তবাহিনীর সঙ্গে আরো এক রকম। বাঘারুর রীতিনীতি বলে কিছু নেই। তিস্তা তার নদীস্বভাবে প্রাকৃতিক, সে জল ছাড়া কিছু নয়। বাঘারু তার মানবস্বভাবে প্রাকৃতিক–সে কেবল মানুষ, একজন মানুষ ছাড়া কিছু নয়।
এই বৃত্তান্ত লেখা এখানেই শেষ হল। তিস্তা ব্যারেজ আরো কয়েক বছর পর শেষ হবে। তখন সেই নতুন, মানুষের তৈরি নদীর সঙ্গে মানুষজনের সহবাসের রীতিনীতি একেবারে আমূল বদলে যাবে। কত দ্রুত আর কতটাই আমূল যে তা বদলায়–তা বদলানোর আগে আমরা ধারণাও করতে পারি না, বদলানোর পরও মাপতে পারি না।
ব্যারেজে জল আটকে ফেলায় কত নতুন জমি চাষে আসবে। ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ায় কত নতুন জমি চাষে আসবে। দুই নম্বর কচুয়ার সঙ্গে মণ্ডলঘাটের আর কোনো তফাত থাকবে না–সেটা মণ্ডলঘাটের ভেতরই চলে আসবে।
নিতাইদের চরটা বোধহয় থাকবে না–ব্যারেজের অত কাছে অত বড় চর রাখা যাবে না। কিন্তু তার বদলে তিস্তার বায়ে বা ডাইনে তিস্তাকে সরিয়ে এনে নতুন জমি বের করে নিতাইদের নতুন গা বসানো হবে হয়ত। দহগ্রামের ছিটমহলগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সীমান্তটা শুধু স্থলভাগ দিয়েই চিহ্নিত করা হবে হয়ত!