এখন সে শ্যাওড়াঝোরার দিকে হাঁটে। তার প্রতিদিনের হাটার মত করে নয়, কারণ এখন তাকে ত কিছু খুঁজতে হয় না–এই নিশুতিতে, অন্ধকারে। এখন তাকে মাইল-মাইল হেঁটে শ্যওড়াঝোরায় ফিরতে হবে–ততক্ষণে রাত আরো কয়েক ঘণ্টা ফুরুবে। কত মাইল তাকে হাঁটতে হয়, সে জানে না–যতক্ষণ না পৌঁছয় সে হেঁটে যাবে।
সে বোঝে কুকুরটা তার সঙ্গে-সঙ্গে চলেছে–কিসের গন্ধে, কে জানে? একবারও ডাকেনি। মাঝে-মাঝে দু-এক পা পেছিয়ে পড়ছে, মাটি শুঁকছে বোধহয়–সেটা মাদারির মা অনুমান করে রাস্তার ওপর কুকুরটির শাস ফেলার প্রতিধ্বনিতে। মাঝে-মাঝেই তার গলাটা লম্বা করে মাদারির মায়ের গায়ের গন্ধ শোকে।
মাদারি ফেরেনি। বাস বা ট্রাক গোলমাল করে থাকতে পারে–যেমন মাদারির মা নিজেই করেছে। তা হলে, মাদারির মায়ের মতই কি সে আর-কোনো গাড়িতে এসে পড়ত না? বাহাদুরের সঙ্গ মাদারি ছাড়ল কেন? এমনিই ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকতে পারে। বা, মাদারিকে দেখেশুনে ফেরত নিয়ে আসছে–সে-দায়িত্ব ত বাহাদুরকে কেউ দেয়নি।
এক হতে পারে–মাদারি চলে গেল, আর-কোনোদিনই ফিরবে না। এত জায়গা থেকে এত গাড়ি এসেছে, এত মানুষ, এত কাজ। পাহাড় বেঁধে নদীর বন্যাকে আটকে দেয়া হচ্ছে, আবার ইচ্ছে মত বন্যা ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, বন্যার জলও নদীর খাত ছেড়ে যেতে পারবে না–এই সব একবার দেখে ফেলার পর, মাদারি আর ফিরতে পারে না। তার ছেলেরা হাসিমারা, শিলিগুড়ি, নেপাল–এই সব দূর-দূর জায়গায় চলে গেছে। মাদারিকে, আর সেভাবে যেতে হল না–সে তার মায়ের সঙ্গেই সেই দূরের একেবারে ভেতরে গিয়ে সেখানেই থেকে গেছে।
রাস্তাটা যেখানে ফরেস্টে ঢুকে পড়ল, সেখানে ফরেস্টের গাছগুলোও যেন রাস্তার ওপর উঠে এসেছে। পাতায়-পাতায় ছাওয়া সেই রাস্তাটাকে একটা গুহার মত লাগে, আরো অন্ধকার গুহা। সেইখানে, প্রায় সীমান্তে, কুকুরটা দাঁড়িয়ে গেল। মাদারির মায়ের নাকে এসে লাগে ফরেস্টের তীব্র ভেজা গন্ধ, সবুজের, এমোনিয়ার। কুকুরটাও সে-জন্যেই দাঁড়িয়ে যায়–এই গন্ধের ভেতর মানুষের সঙ্গে সঙ্গে থাকা কুকুর ঢুকতে ভয় পায়। ঐ গন্ধের ভেতর অনেক বেশি ছায়া, অনেক বেশি আওয়াজ, অনেক বেশি গন্ধ। মাদারির মায়ের গায়ে কুকুরটি সেই কোন আরণ্যক জন্মান্তরের গন্ধ পেয়েই কি কুকুরটা সঙ্গ নিয়েছিল?
সেই অন্ধকার গুহার মত রাস্তা দিয়ে তরতরিয়ে মাদারির মা চলে যায়। ঐ গন্ধের ভেতরে, আরো ভেতরে, ঢুকে যায়। তার নিজের পায়ের সঙ্গে রাস্তার ঘর্ষণের আওয়াজ এমনই তীব্র হয়ে কানে আসে যে জঙ্গলের আওয়াজগুলো তার কানে আসে না। সে খুব একটা কানও দেয় না।
রাত্রির পশুর মত খর অথচ সতর্ক পায়ে মাদারির মাকে সেই ঢাল আর বাক পেরিয়ে তার তৈরি, শ্যাওড়াঝোরার জলেভেজা ন্যাশন্যাল হাইওয়েতে দাঁড়াতে হয়। তার সামনের অন্ধকারটা, একটা পাথরের মত গোটা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেই পাথরটা, অন্য আকার পায়। তার শ্যাওড়া গাছটার যে-ডালটা ওপরের দিকে উঠে গেছে তা অন্ধকারে দাঁড়ানো হাতির গুঁড়ের মত দোলে আর যে-ডালটা নীচে নেমে গেছে তা অন্ধকারের হাতির মত ঝোরা থেকে জলপান করে।
এই জাতীয় সড়ক দিয়ে ভারতবর্ষ যাতায়াত করে, রোজ। আজ মাদারির মা দেখে এল মানুষ পাথর। বেঁধে-বেঁধে নদী বানাল, নদীর বন্যা বানাল, তৈরি করা বন্যার সে-জলও খাত মেনে চলে–উপছোয় না।
মাদারির মায়ের কাছে এই সবই অবান্তর–এই জাতীয় সড়ক, এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করা ভারতবর্ষ, ঐ নদী, ঐ ব্যারেজ, ঐ বন্যা। সে জাতীয় সড়কের পাশেই তার নিজের নদী, নিজের বৃক্ষ, নিজের পাথর দিয়ে নিজের শ্যাওড়াঝোরা তৈরি করে নিয়েছে। তার নিজের তৈরি শেষ মানুষটিও ছিল, আজ থেকে আর-থাকল না বোধ হয়।
মাদারির মা কোমর বেঁকিয়ে চড়াইটা পেরিয়ে তার পাতার ঘরের দিকে উঠতে শুরু করে।
বহু-বহু মাইল দূর থেকে সেই কুকুরটার প্রবল কান্না এতক্ষণে একটানা ছুটে আসে অন্ধকার গুহার মত সেই জাতীয় সড়ক দিয়ে–এই ফরেস্টে এখন মনুষ্যপালিত কোনো পশুরও প্রবেশ নিষেধ।
বাকি রাতটুকুর জন্যে মাদারির মা তার পাতার ঘরে প্রবেশ করে।
.
এ বৃত্তান্ত এখানেই শেষ করা ভাল-সব বৃত্তান্তই ত একটা যোগ্য জায়গায় শেষ করতে হয়। এবৃত্তান্তের পক্ষে এটা বেশ যোগ্য জায়গা। মাদারির মায়ের পক্ষে দূরতম ভ্রমণশেষে ঘরে ফিরে আসা–একা। মাদারি ফেরে না।
শেষ না করলে ত এ বৃত্তান্ত চলতেই থাকবে–পরদিন, তার পরদিন, তার পরদিন।
কারণ, মাদারির মা ভারতবর্ষের প্রায় আশি কোটি মানুষের মধ্যে সেই ছ-সাত কোটির এক জন, যারা, বনের পশুর নিয়মে বাঁচে। দারিদ্র্যসীমা, পশ্চাদপদ অংশ, ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দ তাকে ঘেঁয় না।
ফলে, মাদারির মায়ের প্রতিদিনের বাঁচাই এক স্বাধীন, সার্বভৌম, স্বরাষ্ট্র, স্বাবলম্বী বাঁচা! সেই বাঁচা, দিনের পর দিন বেঁচে থাকা নয় মাত্র, প্রতিটি দিনই একটা পুরো জীবন বাঁচা, একটা গোটা মানবজীবন বাঁচা। সেই বাঁচার নিয়মেই সে তিস্তা ব্যারেজ, কাবেরী ব্যারেজ, হীরাকুঁদ ড্যাম, ভাকরানাঙ্গাল এই সবের বিরুদ্ধে তার নিজের এক শ্যাওড়াঝোরা বানাতে পারে। সেই ধাচার নিয়মেই নিশিদিন ভারতবর্ষ যাতায়াত করে এমন একটা সড়কের পাশে নিজের এক রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে।