মাদারির মা একের পর এক গোখা মুখ দেখে যায়।
বড় বেশি চেনা এই সব ছোট-ছোট মুখ, প্রবল চিবুক আর তীব্র হনু। বয়স খুব একটা বোঝা যায় না বলে সে প্রায় কোনো মুখই বাদ দিতে পারে না আর হঠাৎ-হঠাৎ এক-একটা মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। কোথায়, কত দূরে তার ছেলেরা গেছে যে দুনিয়ার মানুষের এই মিছিলেও তারা কেউ আসে না! তার একটা-দুটো ছেলে এ মিটিঙে আছেই, শুধু খুঁজে যেতে হবে, প্রতিদিনের খাদ্য খোঁজার মত ধীরে, অত্যন্ত ধীরে, দৃষ্টিটাকে তীক্ষ্ণ অভ্রান্ত রেখে, এই রৌদ্রভাসিত প্রান্তরেও অভ্রান্ত রেখে।
এর ভেতর প্রবল জয়ধ্বনির মধ্যে, স্লুইস গেটের অবকাশ দিয়ে কৃত্রিম বাঁধে ধাধে প্রবাহিত তিস্তার জল তার স্বাভাবিক গতির চাইতে বহুতর গুণ বেগে নিজেরই খাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আকাশে ফেনা ছুঁড়ে, ছুটে যায় এই মিটিঙের হাজার-হাজার মানুষের সামনে ভবিষ্যতের প্রতীক হয়ে। মাদারির মা সেই মুক্ত সফেন জলরাশির দিকে তাকায় না। তার কাছে এই ব্যারেজ, এই স্লুইস গেট, এই নদীনিয়ন্ত্রণ, এই মঞ্চ,. এই জয়ধ্বনি অবান্তর। তিস্তার জল এমনিতেও তার শ্যাওড়াঝোরায় যায় না। ব্যারেজ হলেও যাবে না। কিন্তু এই জলরাশিকে, এই নতুন তিস্তাকে অভিনন্দন জানানো জয়ধ্বনিমুখর মুখগুলো তার পক্ষে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। এই মুখের অরণ্যে তার ছেলেদের মুখগুলো আছে। খুঁজতে হবে। মাদারির মাকে ধীরে পায়ে খুঁজতে হবে। ফরেস্টের ভেতর যে-পদক্ষেপে সে রোজ তার খাদ্য খোঁজে, সেই পদক্ষেপে খুঁজতে হবে।
মাদারির মা একের পর এক মদেশিয়া মুখ দেখে যায়–তার ছেলেদের সমবয়সী মুখ বড় বেশি চেনা এই মুখের লম্বা ধাচ, চওড়া কপাল, চোয়ালের চওড়া হাড়।
.
২১৮.
মাদারির মায়ের স্বরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন-অন্ত্যপর্বের শেষ অধ্যায়
রাত মাঝামাঝি কাবার হয়ে যাবার পর একটা ট্রাক ন্যাশন্যাল হাইওয়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে মাদারিহাটের হাটখোলায় দাঁড়িয়ে পড়ে, কিন্তু স্টার্ট বন্ধ করে না। ট্রাকভর্তি মেয়েপুরুষ ঐ আচমকা থামার ঝাঁকুনিতে ঝিমুনি থেকে জেগে ওঠে। ট্রাকের ভেতরের এক কোণ থেকে ক্লিনার নিদ্রিত গলায় বলে ওঠে, কে নামবেন, মাদারিহাটে, নামেন।
মাদারির মা ট্রাকের পেছনে বসে ছিল। সে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে তাকিয়ে মাটির দূরত্ব দেখে নেয়। ক্লিনার আর-একটু কম নিদ্রিত গলায় বলে, এদিক দিয়ে নামেন, এদিক দিয়ে। বলে ক্লিনার উঠে দাঁড়ায়! পুরো ট্রাকটা পার হয়ে মাদারির মাকে সামনে দিয়ে নামতে হবে।
সে বা পাশ দিয়ে এগতে-এগতে চাকার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ডালাটা ধরে বা-পাটা নামিয়ে চাকার ওপর রাখে, আরে, আরে পড়ে যাবেন, পড়ে যাবেন, ক্লিনারের এই কথা শুনতে-শুনতে ডান পাটাও সে চাকার ওপর নামায়, তারপর চাকার ওপর থেকে বা পাটা মাটির দিকে নামায়–ট্রাকের ডালা ধরে থাকা হাত টানটান করে যতটা ঝোলা সম্ভব ঝুলে হাত ছেড়ে দেয় আর রাস্তার ওপর ধুপ করে বসে পড়ে। ক্লিনারটি ওদিক থেকে এদিকে এসে উঁকি দিয়ে দেখে, ততক্ষণে মাদারির মা দাঁড়িয়ে পড়েছে। ক্লিনার ভাল করে তাকে দেখে নিয়ে ড্রাইভারের কেবিনের পেছনে চড় মারে। রাতময় একটা আওয়াজ তুলে ট্রাকটা সোজা বেরিয়ে যায়–আওয়াজের প্রতিধ্বনিকে দীর্ঘ, দীর্ঘ করে। বাঁক নিতেই ট্রাকের লাল আলোটা আর মাদারির মা দেখতে পায় না, কিন্তু আওয়াজটা অনেকক্ষণ ধরে শুনতে পায়। এবং-শোনে।
মাদারির মা তার গাড়ি হারিয়ে ফেলেছিল। শেষে এক ভদ্রলোকের ছেলে, তাকে নিয়ে খুঁজে-খুঁজে এই ট্রাকটাতে তুলে দিয়েছে, ট্রাকটা মাদারিহাটের ওপর দিয়ে ফালাকাটার দিকে যাবে।
ট্রাক চলে যাবার পর মাদারির মা সেই নিশুতরাতের মাদারিহাটের একই জায়গায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। মাদারি আগে এসে কোথাও বসে থাকতে পারে, সে যাতে তাকে দেখে মাই গে বলে ডেকে উঠতে পারে সেজন্যে মাদারির মা নিজেকে দৃশ্যমান করে রাখে—-ঐ রাতে ঐ অন্ধকারে যতটা দৃশ্যমান করে রাখা সম্ভব।
মাদারি যদি তার অপেক্ষায় কোথাও বসেই থাকত এই হাটখোলায় তাহলে ট্রাক থামলেই চলে আসত। অবিশ্যি ঘুমিয়ে পড়ে থাকতে পারে।
মাদারির মা রাস্তা ছেড়ে রাস্তার পাশের দু-একটা দোকানের বারান্দা দেখে। ঘোমশাইয়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। তার বাইরে থেকে মাদারির মা ডাকে-হে-এ মাদারি, মাদারি, হে-এ মাদারি। একটা কুকুর অন্ধকারের ভেতর থেকে নিঃশব্দে এসে মায়ের কোমরের দিকে তার নৈশ গ্রীবা তুলে দেয়। তার ঘন নিশ্বাসের বাতাস মাদারির মায়ের কোমরে, উরুতে, লাগে। সে কি খাবার চায়, নাকি সঙ্গ, নাকি আক্রমণই করতে চায়–বোঝা যায় না।
মাদারির মা ডাকে, হে-এ মাদারি, মাদারি গে, মাদারি।
এবার ভেতর থেকে বাহাদুরের ঘুমজড়িত স্বরে জবাব আসে, মাদারি গাড়িত আসে নাই।
মাদারি আসে নাই। এলে ত বাহাদুরের গাড়িতেই মাদারি আসবে। নাকি মাদারি আর বাহাদুরও ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল? কুকুরটার আরো ঘন শ্বাস মাদারির মায়ের গায়ে লাগে। মাদারির মা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করে, মাদারি কোটত গেইল? একবারই জিজ্ঞাসা করে। সে জানে এই প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যাবে না, তাই একটু দাঁড়িয়ে থেকে সে আবার রাস্তায় ওঠে।