মাদারির মা মিটিঙের ভেতরে ঘুরে-ঘুরে বেড়ায়। এত মানুষ এসেছে যেন মনে হয় দশটা মাদারিহাট এই মিটিঙের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। হাটে ত তাও দোকানের জন্যে জায়গা ছাড়তে হয়, খদ্দেরদের চলাফেরার জন্যে রাস্তা রাখতে হয়। কিন্তু এখানে ত মানুষে-মানুষে কাধ লাগিয়ে বসে আছে, দাঁড়িয়ে আছে–ফরেস্টের গাছের মত, একটা গাছের সঙ্গে আর-একটা গাছের কোনোনা-কোনো একটা সংযোগ থাকেই।
মানুষই ত ভালবাসছিল মাদারির মা, মানুষের আওয়াজ, মানুষের চামড়ার গন্ধ, মানুষের সব কিছু। যেন, সে যখন এই জলুশটাতে এসে পড়েইছে, এত মানুষের ভেতরে এতক্ষণ যখন সে থাকতে পারছেই, তখন, তার এই ভাল লাগাটা সে পুরো উশুল করে নেবে।
কিন্তু মানুষকে ভালবাসতে বাসতে, মানুষের আওয়াজ শুনতে-শুনতে, মানুষের গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতেও মাদারির মা তার ছেলেদের খুঁজছিল। এখানে ত সারা দুনিয়ার মানুষ এসেছে। এত মানুষ এক সঙ্গে কোনো দিন মাদারির মা দেখেনি। তার বাকি জীবনে সে আরো একবার এত বড় মিটিঙে কখনো আসতে পারবে না। আজকের জলুশ যে এতই বড় আর, তাদের যে সেই মাদারিহাট থেকে এই এত দূরে আসতে হবে–তা সে ভাবেও নি। এই জায়গাটাকে যদিও তার তত অপরিচিত ঠেকে না–এমন বড় নদী না দেখলেও ত সে তোসর জল ও চর দেখেছে আর নদীর পাশের এই ফরেস্ট। কিন্তু আসতে-আসতে রাস্তাটা দেখে তার মনে হচ্ছিল সত্যি তারা এত দূরে যাচ্ছে যে আর শ্যাওড়াঝোরায় ফেরা যাবে না। দেশ বোঝে না মাদারির মা, কিন্তু বিদেশ বোঝে। এত দূর বিদেশেও সে কি আর-কোনো দিন আসবে? তা হলে সে তার ছেলেদের একবার খুঁজে দেখবে না, এখানে? তার আটটি কি দশটি সন্তানের মধ্যে দুটি-একটি ত এই মিটিঙে এসে থাকতেই পারে।
মাদারির মা যে খুব একটা নিয়ম মেনে খোঁজে, তা নয়। এই মিটিঙে কোন-কোন জায়গা থেকে লোক এসেছে, তা ত সে জানতে পারবে না। তার ছেলেরা কোথায়-কোথায় চলে গেছে, তাও সে জানে না। তা হলে আর জায়গা মিলিয়ে-মিলিয়ে সে খুঁজবেই বা কেমন করে? তাকে এই হাজার-হাজার মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াতে হয়, হেঁটে বেড়াতে হয়, যেমন সে প্রতিদিন ঘুরে বেড়ায় ফরেস্টের মাটির দিকে চোখ রেখে তার খাদ্যের সন্ধানে। এমন একা-একা হাটা আর খোঁজা, খোঁজার জন্যে হাঁটাই ত তার রোজকার জীবন।
কিন্তু এখানে ফরেস্টের অন্ধকার নেই, এখানে পচা শুকনো পাতা নেই, এখানে লতাপাতার জঙ্গলের আড়াল নেই, এখানে ভেজা মাটি নেই। এখানে, আকাশ থেকে রোদ মাটিতে সম্পূর্ণই আসছে–একটা মেঘের ছায়ার বাধাও নেই। এত বড় আকাশ থেকে এত রোদ এত দূর পর্যন্ত ঝরে পড়ছে যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। এখানে, সামনে আকাশ পর্যন্ত চওড়া একটা নদীকে দু-টুকরো করে শুকনো খটখটে সিমেন্টের দেয়াল সেই আকাশ পর্যন্তই ছড়িয়ে গেছে। এখানে পায়ের নীচে শক্ত মাটি, সবুজ ঘাসের মাটি। এখানে এই রোদে আর এই হাওয়ায়, এই নদী আর এই জলের সামনে এই হাজার-হাজার মুখ। সব মুখ একই দিকে উঁচু করা–সামনে মঞ্চের দিকে তাকাতে ঘাড়টা একটু হেলাতেই হয়। মঞ্চের মানুষগুলোর চোখ এখান থেকে দেখা যায় না, কিন্তু, তাদের হাত নাড়ানোটা বোঝা যায়। সেই হাজার-হাজার একটু উঁচু করা মুখের প্রায় প্রত্যেকটা খুঁটিয়ে দেখার এমন সুযোগ মাদারির মা আর-কোথায় পাবে?
তাই মাদারির মা হাঁটে, তার প্রতিদিনের হাটা-হাঁটে। প্রতিদিনের মত বেগেই হাঁটে। ধীরে-ধীরে। তাড়াহুড়ো নেই। যা খুঁজছে তা খুঁজে যেতে হয়, তাড়াহুড়ো করলেই পাওয়া যাবে, তা নয়। শুধু বেঁচে থাকার জন্যে দরকারি খাদ্যটুকু ফরেস্টের ভেতর থেকে জোগাড় করতে যে-প্রয়াসহীন ক্লান্তিহীন হাঁটা হাঁটতে হয়–তেমনি ভাবে সে হাটে। শুধু তার হাতে অস্ত্র হিশেবে সেই লাঠিটা নেই, তলার দিকে। সমকোণ হয়ে যাওয়া সেই লাঠিটা, যা মাথার ওপর তুলে সে খঙ্গের মত নামিয়ে আনতে পারে, নির্ঘাত। এখন তার হাতে কোনো অস্ত্র নেই, শুধু চোখদুটো আছে, চোখের সেই দৃষ্টিটুকু আছে। এত রৌদ্রভাসিত, বায়ুতাড়িত মুক্ত জায়গায় এত মানুষের ভিড়ে চোখের দৃষ্টি সে অত তীব্র না করলেও পারত।
মাদারির মা হটে আর সেই ব্যগ্র মুখগুলির দিকে চাপা তীব্রতায় চেয়ে যায়। কতগুলো গর্ভ সে ধরেছে তার একেবারে ঠিক হিশেব তার পক্ষে দেয়া সম্ভবই নয়। কোনোদিন ত সেভাবে সন্তানদের হিম্পূের্বাব্লাখেনি। কিন্তু, একটা ছেলে ছাড়া ত তার কোনো সময়ই চলেনি। আর, ছেলেরা মাথায় একটু লম্বা হলেই ত চলে গেছে। ততদিনে ত আর-একটি ছেলে এসে গেছে।
মাদারির মা এখন তার সেই সব ছেলেদেরই খুঁজছে।
সে একের পর এক মুখ দেখে যায়–এই মুখগুলি তার চেনা রাজবংশী মুখ। একটা আন্দাজ ত তার আছে তার ছেলেদের বয়স এখন কত হতে পারে-ওপরের দিকে। তাই সেই আন্দাজি বয়সের চাইতে বয়স্ক মুখগুলো এক পলক দেখেই সে সরে যায়। আর, তার ছেলেদের আন্দাজি বয়সের সীমার মধ্যে পড়তে পারে এমন যে-কোনো মুখের দিকেই সে নিবিড় ভাবে এক পলক চায়।
এরকম চাইতে-চাইতে মনে-মনে সে তার ছেলেদের কথাটা একবার যাচাই করে নেয়। নেপালি জ্যেষ্ঠপুত্রের কথা আর তার পরের মদেশিয়া ছেলের কথা পরপর মনে আসে। কিন্তু তারপর সব গোলমাল হয়ে যায়। কোন ছেলে আগে–সেই মিলিটারি, নাকি সেই রাজবংশী দেউনিয়াসে নিশ্চিতভাবে মনে করতে পারে না। তার বাকি সব ছেলে যে-কোনো বয়সী হতে পারে।