মুখ্যমন্ত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, বলুন না। আপনি কি নতুন মন্ত্রী হলেন?
হ্যাঁ। আমার এখন সবচেয়ে বেশি সময় যায় মধ্যমপুরুষ বহুবচনের অর্থ বুঝতে। মানে, কখনো আমাকে বলা হয় তোমাদের কথা ছাড়ো, তোমরা ত ভারতের নয়া শাসক। তখন বুঝতে হয়, আমি ইউ-পির লোক। কখনো বলা হয় প্রধানমন্ত্রীর নতুন ছেলেরা। তখন বুঝতে হয়, আমি প্রধানমন্ত্রীর লোক। কখনো বলা হয়–তোমরা ব্রাহ্মণ। এই পর্যন্ত বলেই মন্ত্রী থেমে যান।
মুখ্যমন্ত্রী সামান্য একটু হেসে বলেন, আপনাদের দলের ত একটা রাজনৈতিক সমস্যা আছেই-এ রাজ্যে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মত পশ্চাদপদ জায়গায় সমস্যাটা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের লোকজন সব দলে-দলে গোখাল্যান্ড, উত্তরখণ্ড, এই সব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের দিকে চলে যাচ্ছে। আর আপনাদের স্থানীয় নেতারা তাদের সঙ্গে-সঙ্গে যাচ্ছে। তাতে একটা বিপদ দেখা দিচ্ছে।
মঞ্চের ওপর থেকে মাইকে শ্লোগান দেয়া শুরু হয় আর দেখতে-দেখতে সামনের সমাবেশ জমাট বেঁধে যায়। মঞ্চের শ্লোগানের জবাবে সমাবেশের হাজার-হাজার মানুষ একসঙ্গে হাত তুলে, শ্লোগান তুলছে। এত মানুষের গলার আওয়াজ এক সঙ্গে কী প্রবল শক্তি হয়ে ওঠে, মুহূর্তে, তা শ্লোগান ওঠার পূর্ব মুহূর্তেও যেন ভাবা যায়নি। এই শ্লোগানই যেন এই মঞ্চ, এই ফরেস্ট, এই নদীর সঙ্গে এই মানুষকে জুড়ে দেয়। এত মানুষ যেখানে এমন সরবে এতটা সমর্থন জানাতে চায় তখন রাজনীতির তত্ত্ব যেন দুই হাতে ধরা যায়, ছোঁয়া যায় এমন এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা পায়।
মঞ্চের এই নেতারা ত সব সময়ই মিটিং করেন। আর বছরে দুবছরে অন্তত একবার ব্রিগেডের জনতা তারা মঞ্চ থেকে দেখে থাকেন। কিন্তু এখানে, এই সমাবেশে, সেই সব অভিজ্ঞতার বাইরের একটা ব্যাপার ঘটে যায়। তিস্তার একটা গম্ভীর ধ্বনি সব সময় শোনা যাচ্ছিল। সেই গাড়ি থেকে নামার পর থেকেই সব সময় সেই আওয়াজটা পরিবেশের সঙ্গে লেগে আছে। অনেকটা যেন দিগন্তের মেঘ-গর্জনের মত। তার সঙ্গে প্রবল বাতাস–তিস্তার জলময় বুক থেকে প্রবল উঠে এসে বয়ে যাচ্ছে। নদীস্রোতের সমান্তরালে অত বড় আকাশের নীচে সে যেন বাতাসের আর-এক তিস্তা। আর, এরই সঙ্গে আছে ফরেস্টের ভেতর দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার অবিরল দীর্ঘশ্বাস, বিরতিহীন, পতনহীন। সেই তিস্তার, ফরেস্টের, বাতাসের আওয়াজের সঙ্গে মিশে শ্লোগানের নাদ বদলে গেছে। আদিবাসী উচ্চারণে শ্লোগানে যেন মাঝে-মাঝে টঙ্কারও জাগছে। এ-শ্লোগানের ভেতর যেন এক বিষাদও মাখানো থাকে–পাহাড়ের বা জঙ্গলের বা নিধুয়াপাথারের গানে যে-বিষাদ থাকে।
যারা ফিল্ম তুলছিলেন, তাদের কয়েকজন গুটিগুটি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়ান, কিছু বলতে। টের পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। বয়স্ক-মত একজন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সুবাদে যার মুখ মুখ্যমন্ত্রী চেনেন, বলেন, স্যার, একটা বিপদে পড়েছি।
কী হল?
আসলে আমরা ত একটা করে ক্যামেরা এনেছি। আর এরা ডায়াস এমন ভাবে বানিয়েছে যে আপনার বোম টেপার শট নেয়ার পর দৌড়ে নেমে আর স্লুইস খুলে যাচ্ছে সেই শট নেয়া যাবে না।
ত, কী, করতে হবে কী?
সুইসের শট নেয়ার জন্যে ত এখন থেকেই ওখানে ক্যামেরা ফিট করে রাখতে হবে। ঐ শট স্যার ঐ মিছিলের ভেতর থেকেই নিতে হবে। ধাক্কাটাক্কা লেগে যেতে পারে।
ফিট করে রাখুন গিয়ে।
ভদ্রলোক এবার আর-একটু হেসে বলেন, আপনি যদি স্যার এখান থেকে একবার হেঁটে ঐ বোতাম টেপার ডায়াস পর্যন্ত যান, ওখানে গিয়ে একবার দাঁড়ান, তা হলে আপনার বোতাম টেপার শটটা এখনই নিয়ে আমরা নীচে চলে যেতে পারি।
ও। এ্যাকটিং করতে হবে? যান, আপনারা যন্ত্রপাতি লাগান গিয়ে।
আমরা লাগিয়েই এসেছি স্যার। শুনে, মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়ান, তারপর দ্রুত পায়ে ডাইনের সেই মঞ্চের দিকে হেঁটে যান, বোতাম টিপছেন–এরকম একটা ভঙ্গি করেন। অনেকগুলো ঘড়ি একসঙ্গে চললে যেমন আওয়াজ হয় সেরকম সমবেত টিকটিক শব্দে ফিল্ম চলতে থাকে। স্যার, হাতটা একটু নাড়ান স্যার। মুখ্যমন্ত্রী হাত নাড়ান।
.
২১৭.
মাদারির মায়ের সন্তান সন্ধান
বক্তৃতায় বক্তৃতায় মিটিং জমে ওঠে।
মঞ্চে এক-একজন বক্তা আসছেন, কেউই বেশিক্ষণ বলছেন না, কিন্তু পর-পর বলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে একটা বক্তৃতাই যেন অনেকক্ষণ ধরে চলেছে।
নদীর কল্লোল, হাওয়ার গর্জন আর ফরেস্টের প্রবল মর্মর যেমন শ্লোগানের ধ্বনি বদলে দিচ্ছিল, তেমনি বক্তৃতার আওয়াজও বদলে দিচ্ছে। বাতাসটা বইছে নদীর স্রোতের অনুকূলে পুব থেকে পশ্চিমে। আর বিরাট-বিরাট, স্পিকারের মুখগুলোও পশ্চিম দিকে। সেই চোঙাগুলো দিয়ে আওয়াজ বেরনো মাত্র বাতাস সে–আওয়াজ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমাবেশের ওপর দিয়ে, ভেতর দিয়ে। তা ছাড়া, নদীর ওপরের বাতাস ত আর জলস্রোতের মত মাটির ঢাল বেয়ে-বেয়ে যায় না। পুবের বাতাস নদীর ওপরের অতটা অবকাশে এলোমেলো বয়ে যায়। যে-সব চোঙ লাগানো হয়েছে তার আওয়াজগুলো এরকম বাতাসের ধাক্কায় এলোমেলো বয়ে যাচ্ছে। ফলে বক্তার একটা কথাই বিভিন্ন চোঙ থেকে বিভিন্নভাবে এসে সেই সমাবেশের ওপর পড়ছে, তারপর মুহূর্তে ভেসে যাচ্ছে তিস্তার জলে কুটো পড়লে যেমন ভেসে যায়।