কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কোনো জবাব দিলেন না। নুড়ি পাথরের স্তূপ তারা প্রায় পেরিয়েই এসেছেন।
মঞ্চের তলা দিয়েই তাদের ব্যারেজের ওপর যেতে হবে। মঞ্চের তলাটাও তাই কাপড় দিয়ে মোড়া ও পেছনে, যেখান দিয়ে তারা ব্যারেজে ঢুকবেন, সেই জায়গাটায় পর্দা ঝোলানো। দুই ইনজিনিয়ার দুদিক থেকে পর্দাটা সরিয়ে ধরেন আর মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ব্যারেজের ওপর পা রেখে দাঁড়ান।
মঞ্চের পেছনে টিভি ক্যামেরাম্যান, প্রেস ফটোগ্রাফার ও রিপোর্টাররা তৈরি হয়েই ছিলেন। যে-পর্দা ঠেলে ওঁরা ঢুকলেন তারই দুপাশে রিপোর্টাররা, মাটির ওপর উবু হয়ে বসে ফটোগ্রাফাররা, একটু দূরে টিভি ক্যামেরা, তার বায়ে সরকারের প্রচারবিভাগের ক্যামেরা, এই দুই-এর মাঝখানে আর-একটু পেছনে ফিল্ম ডিভিশনের দল। একটা ক্যাসেট-রেকর্ডার কাঁধে ঝুলিয়ে লম্বা একটা মাইক্রোফোন নিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিও।
মুখ্যমন্ত্রীও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এসে দাঁড়াতেই একসঙ্গে ফ্ল্যাশ জ্বলে, টিকটিক করে মুভি ক্যামেরা তিনটি চলতে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী একটু ডান দিকে তাকান যেদিকে তিস্তার জল ফুলে-ফুলে উঠছে। তারপরই কয়েক পা এগিয়ে যান কারণ ততক্ষণে পেছনের পর্দা ঠেলে বাকি ভি-আই-পিরাও এসে গেছেন, তার মধ্যে জনাকয়েক মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী মাঝখানে যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, দাঁড়িয়ে থাকেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তার পাশে। অন্য মন্ত্রী কজন এদের দুপাশে নিজেদের জায়গা করে নেন, পেছনে অফিসাররা দাঁড়িয়ে পড়েন। কেউ কিছু বলার আগেই গ্রুপ ছবির মত করে সবাই দাঁড়িয়ে যান এবং মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরই এই পুরো দলটা হাঁটতে শুরু করে।
যারা ছবি তুলছেন ও যাদের ছবি তোলা হচ্ছে এই দুই দলের মধ্যেই অদ্ভুত বোঝাপড়া কাজ করে। প্রত্যেকেই জানেন, কখন কী করতে হবে। এমন-কি প্রেস ফটোগ্রাফাররা এগিয়ে গিয়ে ছবি তোলার সময়ও সচেতন থাকেন যেন যারা মুভি তুলছেন তাদের ক্যামেরার পথে বাধা না হন। প্রায় দৈনন্দিন অভ্যস্ততায় তারা এই অনভ্যস্ত পথে হাঁটছিলেন, তিস্তার বুকের ওপর দিয়ে তিস্তা পেরচ্ছিলেন, অথচ যেন সেই কথাটা কেউই খেয়াল করেন না।
.
২১৬.
অভিনয়ে স্লুইস গেট খোলা
উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়।
উত্তরবঙ্গের এমএল-এরা কেউ-কেউ বলবেন—-দার্জিলিং থেকে মালদহ পর্যন্ত। উত্তরবঙ্গের এম-পিরা বলবেন। কংগ্রেসের কোনো এম-পি আসেননি, বলবেন প্রধানত রাজ্যের সরকারি দলের এম-পিরা। তারপর যার-যার দপ্তর এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা বলবেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী, পি-ডবলু-ডি মন্ত্রী। শেষে বলবেন বিশেষ অতিথি কেন্দ্রের মন্ত্রী। আর তারপর মুখ্যমন্ত্রী বলবেন ও বলার শেষে, আর-এক মঞ্চ থেকে বোম টিপে স্লুইস গেট খুলবেন। বেলা দুটোর মধ্যে সমস্ত প্রোগ্রাম শেষ করতে হবে। তারপর ভি-আই-পিরা চলে যাবেন, তারপর মিছিলগুলো ফিরতে শুরু করবে।
মিছিল জড়ো হয়েছে ব্যারেজের দক্ষিণে, ভি-আই-পিদের গাড়ি রাখার জায়গার পেছন থেকে তিস্তার পাড় ধরে–যতদূর চোখ যায়। জায়গাটা আগেই পরিষ্কার করা ছিল কিন্তু এতটা জায়গা নয়। ব্যারেজের জলের জন্যে এখানটা খোলা রাখারই কথা। পরে এই খোলা জায়গাসহই এই অংশটাকে নিশ্চয়ই কাটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়া হবে অথবা অন্য কোনো ভাবে পাহারাধীন রাখা হবে কারণ মানুষের পক্ষে এই জায়গাটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। স্লুইস খুললে এখান দিয়েই ত সবচেয়ে জোরে জল বইবে–প্রায় জলপ্রপাতের বেগে। তা ছাড়া ব্যারেজের নিরাপত্তার জন্যেও এত কাছে কাউকে আসতে দেয়া হবে না।
দুদিন ধরে ফরেস্টের নীচের জঙ্গল কেটে ঐ মাঠটাকেই আরো বড় করে দেয়া হয়েছে। ওরও পেছনে এক জায়গায় সারি দিয়ে ট্রাকগুলোকে দাঁড় করানো হচ্ছে। মঞ্চ থেকে দেখাচ্ছে, যেন মানুষের মাথা আর ফরেস্টের গাছ মিশে গেছে। মঞ্চে একজন ইনজিনিয়ারের হাতে মেড-ইন হংকং একটা বাইনোকুলার ছিল–সেটাই সবার হাতে-হাতে ঘুরছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখলেন। তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে দিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীটি তরুণ। তিনি ঠিক এত বড় সমাবেশের সঙ্গে খুব পরিচিত নন। এই সমাবেশ গড়ে তুলতে যে-শ্রম, নিষ্ঠা, ও ধৈর্য দরকার, তার দলের কাজকর্মের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেটা মেলে না। ঠিক বুঝে উঠতেও পারেন না, ব্যাপারটা কী। তিনি ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে বাইনোকুলারটি ফেরত দেয়ার জন্যে হাত বাড়ালে পেছন থেকে একজন নিয়ে নেন। মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি মন্তব্য করে ফেলেন, আপনার জনপ্রিয়তা যে এতটাই আমার ধারণা ছিল না।
মুখ্যমন্ত্রী স্মিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সমাবেশের দিকে তাকান। সমাবেশের শ্লোগান, হৈ-হৈ সব শোনা যাচ্ছে কিন্তু মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে না, মঞ্চটা এতই উঁচু আর সমাবেশটা এতই দূরে। কোথায় একটু বিষণ্ণতা এসে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি একটু জোর দিয়ে বলেন, আপনাদের জন্যেই আমাদের এই সমাবেশ সংগঠিত করতে হল। আমাদের ও সমাবেশ কথা দুটির ওপর মুখ্যমন্ত্রী একটু অতিরিক্ত জোর দিলেন। তারপর যোগ করেন, পশ্চিমবাংলাকে ত আমরা পাঞ্জাব হতে দিতে পারি না। এ-কথাটার মধ্যেও জোর ছিল, যেন, মুখ্যমন্ত্রী তার বক্তৃতার লাইন বলছেন। তাঁর বক্তৃতার এই জোরটাই বৈশিষ্ট্য, শুনলে আত্মবিশ্বাস আসে যেমন, তেমনি, ওঁর ওপর নির্ভরতাও আসে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর কথাটাকে একটু বুঝে নেন। মনে হয়, মুখ্যমন্ত্রীর কথার মধ্যে তাদের দলের বা সরকারের বিরুদ্ধে যে-সমালোচনার ছোঁয়া ছিল সেটা আর তিনি ঘটাতে চান না। বিষয়টা তিনি জানেনও না, আর, মুখ্যমন্ত্রীর কথা তিনি শুনেছেন অনেক, সকলেই ত বেশ শ্রদ্ধা করেন। এই প্রথম তার সঙ্গে আলাপ। মিছিমিছি একটা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসে তিনি বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়তে চাইছেন না। ইংরেজির কুশলতায় তিনি কথাটা-এড়িয়ে যেতে চাইলেন, মন্ত্রী হওয়ার পর আমার সবচেয়ে বেশি সময় কিসে লাগছে, আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে।