.
২১৫.
নদীর বুকের ওপর দিয়ে হাঁটা
মানাবাড়ি থেকে আপলচাঁদ পর্যন্ত রাস্তা ফাঁকা রাখা হয়েছে।
ভি-আই-পিদের নিয়ে চল্লিশটা গাড়ি, ছটি মোটর সাইকেলের পাহারায় সেই সরু রাস্তায় ঢুকে যায়। এখানে পাহাড় নেই ও জঙ্গলও নেই। ফলে নিরাপত্তার প্রশ্ন কিছুটা সরল। মোটর সাইকেলের পুলিশরা তাদের গতি একটু কমিয়ে আনে। এখানে ভি-আই-পিরা একটু অলস ভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ দেখতে পারেন। পেছনের গাড়িগুলোর গতিও স্বাভাবিক ভাবেই কমে আসে। একটা শিথিলতা অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে পুরো কনভয়টাতেই ছড়িয়ে পড়ে–অবকাশের শিথিলতা।
আপলচাঁদের কাছে পৌঁছে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে যায়। একটা রাস্তা সোজা চলে যায়, আর-একটা ডাইনে। এই ডাইনের রাস্তাটা নতুন বানানো হয়েছে– ব্যারেজের জন্যে। সোজা রাস্তাটাও ব্যারেজেই গেছে, ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে একটু ঘুরে। ভি-আই-পিদের গাড়িগুলো ব্যারেজের নতুন রাস্তা ধরে আলাদা হয়ে গেলে–মানবাবাড়ি থেকে ট্রাকগুলো ছাড়া হয়। মিছিলের ট্রাক পুরনো রাস্তা ধরে ব্যারেজের কাছে নির্দিষ্ট জায়গায় যাবে।
ভি-আই-পিদের কনভয় সোজা ব্যারেজের মুখে চলে যায়। গাড়ি থেকে নেমে তাঁরা মঞ্চে যাবার রাস্তায় পা দেন। আর গাড়িগুলো সোজা গিয়ে গাড়ি রাখার নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ছোট-ছোট প্ল্যাকার্ডে জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে–সি-এমস কার, ইউনিয়ন মিনিস্টার অব স্টেটস কার ইরিগেশন মিনিস্টারস কার, পি-ডব্লু-ডি মিনিস্টারস কার ইত্যাদি।
গাড়ি থেকে মঞ্চে যাবার রাস্তাটা নতুন করে বানানো হয়েছে এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জন্যে। তিস্তার শুকনো খাত থেকে ছোট নুড়ি পাথর তুলে এনে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। জলের নীচে থাকলে এগুলোর আলাদা-আলাদা রঙ দেখা যায় কিন্তু রোদে সে রঙ নষ্ট হয়ে যায়। যাতে অন্তত কিছুটা রঙ থাকে, সেজন্যে কাল রাতে এই সব পাথর তোলা ও বেছানো হয়েছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টও কাল রাতেই দুট্রাক গাছ দিয়েছে, সেগুলো রাস্তার দুপাশে পুঁতে দেয়া হয়েছে। সে-সবই গোটা-গোটা গাছ-দুদিনের মধ্যে শুকিয়ে মরে যাবে, কিন্তু, এখন দেখাচ্ছে যেন কত শুশৃষায় এই সব গাছকে বড় করা হয়েছে। গাছ ত আর রাতারাতি বড় হয় না–তাই একটা গাছ বহু বছরের যত্নের প্রমাণ দেয়।
ওঁরা নেমে একটু দাঁড়ান। অনেকে দুহাত ওপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে নেন সশব্দ হাই তুলে। দু-একজন একটু চারপাশে তাকান–প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার তৃপ্তি পেতে। মুখ্যমন্ত্রী একটু অন্যমনস্ক ভাবে তৈরি থাকেন–নিশ্চয়ই কেউ এসে বলবেন কী করতে হবে। সেই মুহূর্তেই ইনজিনিয়াররা এসে প্রত্যেকের বুকে বড় বড় ব্যাজ এঁটে দেন। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাজটা সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে রঙিন।
ওতে খানিকটা সময় যায়। কেন্দ্রের জলপথমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এসে জানতে চান পাহাড় এখান থেকে কত দূর হবে, মানে কোন জায়গায় নদী সমতলে নেমেছে। মুখ্যমন্ত্রী নদীর ওপারের দিকে তাকান। ওপারটা দেখতে তাকে কোনাকুনি তাকাতে হয়, কারণ সোজা পথটা আটকে রেখেছে মঞ্চ। তারপর একটু আনমনা ভঙ্গিতে ডান হাতটা দিয়ে একটা দিক দেখান। উত্তরটা খুব সম্পূর্ণ হল না ভেবে হাতটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে জানান–পশ্চিমবঙ্গের পাহাড় অঞ্চল, সিকিম ও ভুটান এই জায়গাটিকে ঘিরে রেখেছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তার চোখ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাত অনুসরণ করে ইংরেজিতে বলেন, এই জায়গাটি দেখতে একেবারে গাড়োয়ালের মত। আপনি গাড়োয়ালে গেছেন?
মুখ্যমন্ত্রী হেসে বলেন, এত বয়স হয়েছে যে ভারতের কোনো জায়গায় আর যাওয়া বাকি নেই। গাভোয়ালে ত গিয়েইছি। সেবার বহুগুণার ইলেকশনে অনেকগুলো মিটিং করলাম, ইলেকশন মানে স্থগিত ইলেকশনে, মিসেস গান্ধীর প্রেস্টিজ ইলেকশনে। আপনি কি গাড়োয়ালের? না ত?
না, না, আমি ত সমতলের লোক। কিন্তু গাড়োয়ালে গিয়েছি, থেকেছিও।
কেন?
আমার কাকার বড় ফলের খেত আছে।
ইনজিনিয়ারদের একজন, মুখ্যমন্ত্রী বুঝে নেন ইনিই নিশ্চয় ব্যারেজের প্রধান ইনজিনিয়ার, এসে বলেন, স্যার, ডায়াসে ওঠার আগে একবার ব্যারেজটা দেখে নিন।
হ্যাঁ। গাভোয়ালে ফলের শিল্প খুব বেড়েছে, হিমাচল প্রদেশেও খুব বেড়েছে। এই শিল্পটা ওখানকার পাহাড়ি লোকদের একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি দিয়েছে। সে জন্যে দেখবেন, উত্তর প্রদেশের পাহাড় অঞ্চলে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নেই–ওরা প্রধান ভূখণ্ডের সঙ্গে থাকতে চায়, তাতেই ওদের লাভ, বলতে বলতে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নিয়ে এগিয়ে যান।
তা আপনি বলতে পারেন না–আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত রাজ্যেই ত খালিস্তান শ্লোগান উঠল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন।
নুড়ি পাথর এত গভীর করে ঢালা যে হাঁটা মুশকিল, জুতো হড়কে যায়। পেছন থেকে একজন মন্তব্য করেন, এত পাথর ঢেলেছেন কেন, মন্ত্রীদের আছাড় খাওয়াবার জন্যে?
একটু আস্তে-আস্তে হাঁটুন স্যার, আমরা ত বাঁধিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, সিকিউরিটি বলল পাথর ঢালতে, একজন ইনজিনিয়ার ব্যাখ্যা করেন।
মুখ্যমন্ত্রী আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই সবার আগে-আগে যাচ্ছিলেন, ধীরে-ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত ভাবে, যেন, ওঁদের একটু বিশেষ ভাবে জানা আছে নুড়ি পাথরে কী করে হাঁটতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পাঞ্জাব ত আসলে আপনাদের পার্টির কেলোর কীর্তি। আপনারা আকালি রাজনীতির ভেতর ঢুকলেন আর তার সঙ্গে পাকিস্তান জড়িয়ে গেল।