ব্যারেজটা যত উঁচু, ততটা উঁচু দেখায় না–তার কারণ তিস্তার মাইল-মাইল বিস্তার, আর পাড়ে এমন আকাশসমান ফরেস্ট। আকাশের কত কাছাকাছি গেছে, তাই দিয়েই ত একটা উচ্চতা মাপা হয়। এখানে সবাইকে আকাশসমান শালগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ব্যারেজটাকে দেখতে হয়। পাড়ের কাছে ব্যারেজের ওপরে বিরাট এক স্টেজ বানানো হয়েছে, এত উঁচু যে ঐ উঁচু পাড় থেকেও চোখ একটু তুলে দেখতে হয়। নানা রঙের কাপড়ে স্টেজটা ঝলমল করছে। স্টেজের দুদিকে দুটি বড় জাতীয় পতাকা আর মাঝখানে সরকারি দলগুলির নিজস্ব পতাকা। স্টেজের বাঁ দিকে আবার একটু বেশি উঁচু মঞ্চ। সেখান থেকে বক্তৃতা হবে। ডান দিকে ঐ একই সাইজের আর-একটা মঞ্চ–ওখান থেকে বোম টিপে স্লুইস গেট খোলা হবে। তিস্তার বুকে সব সময়ই জোর বাতাস থাকে। সেই বাতাসে স্টেজের কাপড়চোপড়গুলো ফুলে-ফুলে ওঠে, ঝালরগুলো বা থেকে ডাইনে ওড়ে, জাতীয় পতাকাদুটিসহ অন্যান্য সব পতাকাই বা থেকে ডাইনে ওড়ে, যেন, মনে হয়, এই যেদিকে মুখ করে মঞ্চ বানানো হয়েছে সেটা সোজা দিক নয়, সোজা দিকটা তিস্তার ভাটি বুকের মধ্যে।
তিস্তা ব্যারেজে আসার রাস্তা একটাই–ঐ মানাবাবাড়ির মোড় দিয়ে। আর-এক আসা যায় লাটাগুড়ি থেকে ক্রান্তিহাট হয়ে আপলচাঁদ ফরেস্ট দিয়ে। কিন্তু ব্যারেজ-উদ্বোধন মানে ত এসে ফিতে কাটা বা বোম টেপাই নয়। ঐ ক্রান্তিহাটের রাস্তায় লোকজন দেখবে কী করে যে মন্ত্রীরা ব্যারেজ উদ্বোধনে আসছেন।
কিন্তু ভিআইপিদের জন্যে ত আর স্বতন্ত্র রাস্তার ব্যবস্থা করা যায়নি। পুলিশ জেলা কর্তৃপক্ষকে বারবার একটা কথাই বলেছে যে কোনো অবস্থাতেই যেন ভি-আই-পিদের আসার সময়টা বদলানো না হয়। শেষ মুহূর্তের সময়বদল সামলানোর মত ব্যবস্থা করা এই তিস্তার চরে, পাহাড়ের তলায়, ফরেস্টের মধ্যে সম্ভব নয়।
সেই নির্দিষ্ট সময়েই ভি-আই-পিদের কনভয় জাতীয় সড়ক ধরে বেশ জোরেই আসে–সামনে ছয় মোটর সাইকেলের এসকর্ট ছুটে গেলে রাস্তায় যত জোরে গাড়ি চালানো যায়।
নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা আগে চালসার মোড়ের সব দিকেই মিছিলের ট্রাক সাইডে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। রাস্তার পাশে রাইফেল কাঁধে পুলিশ দাঁড়িয়েই ছিল– ট্রাকগুলো দাঁড়ানো মাত্র এক-একজন এক-এক ট্রাকে উঠে পড়ে রাস্তার দিকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে পড়ে।
চালসার মোড়ে টিলার ওপরে গাছপালার সবুজের সঙ্গে মিশে কিছু কম্যান্ডো ফোর্স ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে–বিশেষত চালসা থেকে মাটিয়ালি যাওয়ার পথের দুপাশে। পুলিশের দিক থেকে এই দুটো পয়েন্টেই সিকিউরিটি রিস্ক আছে–দাঁড়ানো ট্রাকের পাশ দিয়েই ত ভি-আই-পিদের গাড়িগুলো আসবে।
ভি-আই-পিদের কনভয়টা চালসার মোড়ে পৌঁছনোর আগেই এসকর্টের মোটর সাইকেলগুলো যেন গতি বাড়িয়ে দেয়। আর সেই বর্ধিত গতির সঙ্গতি রেখে কনভয়ের সব গাড়ির গতিই বেড়ে যায়। সেই প্রবল গতিতে চালসার মোড়ে ছটি মোটর সাইকেলের পেছনে অন্তত চল্লিশটি গাড়ি বাঁক নেয় রাস্তার সঙ্গে টায়ারের সংঘর্ষে একটা আওয়াজ কয়েক সেকেন্ড পরপরই উঠতে থাকে। সমকোণে দাঁড়িয়ে থাকা যাওয়ার মিনিট তিন পর যখন পথ খুলে যায়, তখন নেতাদের পেছনে-পেছনে মিছিল যাচ্ছে–এই বোধটা ফিরে আসে আর সব ট্রাক থেকেই শ্লোগান উঠতে থাকে।
মানাবাড়ির মোড়ে একই ঘটনা। সেখানে একই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনের আগে সব ট্রাককে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। মানাবাড়ি থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত ফাঁকা রাস্তায় সেই চল্লিশটি গাড়ি ও ছটি মোটর সাইকেলকে বাধ্যতই একটু ধীর গতিতে বাক নিতে হয় রাস্তাটা ছোট। কিন্তু তৎসত্ত্বেও দাঁড়িয়ে থাকা মিছিলে কোনো শ্লোগান ওঠে না। একটা গাড়ির জানলা দিয়ে কোনো একজন নেতা হাত বাড়িয়ে খানিকটা নাড়ান। তাতেও রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়া মিছিল বুঝে উঠতে পারে না তাদের কাছে এখন কোন ব্যবহার প্রত্যাশিত। এক অদ্ভুত ধাঁধায় এই মিছিলও পড়ে গেছে আর নেতাদের নিয়ে আসা চল্লিশটি গাড়িও পড়ে গেছে। মিছিলের অংশ হবেন বলেই নেতারা মিছিলের পাশ দিয়ে, বা, ভেতর দিয়ে, বা, মিছিলের সঙ্গেই যেন ব্যারেজে আসতে চেয়েছেন, তাই ত এই পথ বেছে নেয়া। আর, উত্তরবঙ্গের পক্ষে বৃহত্তম এই কর্মযজ্ঞ উপক্ষে বৃহত্তম এই সমাবেশেরও ত উল্লসিত হয়ে ওঠার কথা তাদের নেতাদের পেয়ে। কিন্তু, কার্যত মিছিল আটকে, রাইফেলধারী পুলিশ আর গোপন কম্যান্ডো বাহিনীর পাহারায় তাদের দাঁড় করিয়ে দেখে, নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সেটা ত সমর্থনযোগ্যই–উত্তরখণ্ড বা গোর্খাল্যান্ড-এর লোকদের হাত থেকে নেতাদের বাঁচানোর দায়িত্ব ত নিতেই হবে। কিন্তু এমনই মানবস্বভাব যে কাউকে যখনই সন্দেহ করা হবে, বা,সন্দেহের সীমার মধ্যে যখন কাউকে টেনে আনা হবে, সে তখনই সন্দেহজনক হয়ে পড়ে। নিজেরই কাছে। সত্যি ত এই এত বড় মিছিলের যে-কোনো ট্রাকে বা বাসে এক দল বা একজন আততায়ী আত্মগোপন করে থাকতে পারে। কিন্তু সেই সত্য আশঙ্কারই আবোরা একটা অর্থ ত এই যে এই আমাদের এই মিছিলের ভেতরই আততায়ী লুকিয়ে থাকতে পারে। একবার এই সত্য পরিষ্কার হয়ে। গেলে মিছিলের মূলে টান পড়ে, তখন নেতাদের চল্লিশ গাড়ি আর মিছিলের শশ ট্রাকের মধ্যে দূরপনেয় পার্থক্য ঘটে যায়। মিছিলের জন্যেই এসেছেন নেতারা, নেতাদের জন্যেই মিছিল আসছে, একই কর্মকাণ্ডের শরিক হবেন নেতারা ও মিছিলের মানুষ, তারপর এই কর্মকাণ্ডের বাণী এই মিছিলই। উত্তরবঙ্গের কোণে-কানাচে নিয়ে যাবে, যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সত্যি করেই করব দেয়া যায়, তাদের কাল হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া যায়। কিন্তু কার্যত নেতাদের জন্যেই মিছিল আটকে রাখা হয়, নেতাদের জন্যেই মিছিলকে উদ্যত ও গোপন রাইফেলের সামনে অন্তত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়, মিছিল থেকে নেতাদের নিশ্চিত ও নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়া যতক্ষণ শেষ না হয়, ততক্ষণ, পুলিশ অন্তত এই মিছিলকেই তার সন্দেহের একমাত্র লক্ষ্য করে রাখে। মিছিল, তার নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, নেতারা তাদের মিছিলের আশ্রয়ে নিশ্চিত থাকতে পারে না–ঐ চল্লিশটি গাড়ি অনেক বেশি নিরাপদ থাকে মিছিল আর নেতাদের মাঝখানে দাঁড়ানো পুলিশের পাহারায়। নেতা আর মিছিল আলাদা। হয়ে গেছে।