যোগানন্দ বলে, কালি থিকা ত এইঠে হলকা ক্যাম্প বসিবে–
ও–নাউছার বুঝে যায়। একটু চুপ করে থাকে। তারপর যেন আপন মনেই বলে, হলকা ক্যাম্পত জমি দিবে আর পশু হাসপাতাল বলদ দিবে, তবে ত মোর এইঠে সোনার সংসার হবা ধরিবে। কথাটা কেউ-কেউ শুনতে পায়, কেউ-কেউ একটু হাসেও। নাউছারের মাথায় এই দুটো সাইনবোর্ডের ব্যাপারটা খেলে গেছে বলেই সে কথাটা বলে। কথাটার মধ্যে কোনো ঝাঁঝ ছিল না। দূর থেকে একজন একটু চেষ্টা করেই নাউছারের নজরে পড়ে, তার পর দূর থেকেই সেলাম জানায়। নাউছার আলম জিজ্ঞাসা করে, কী, বিবি হাসপাতালঠে ফিরি আইসছে? লোকটি হেসে ঘাড় কাত করে। বেশ বেশ বলে নাউছার তার পাশের লোকটিকে কিছু বলতে মুখ ঘোরায়।
নৌকো পাড়ে ভিড়ে গেছে। নাউছারের পাশে পাড়ের দিকে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা আস্তে নেমে যায়, নৌকো দুলিয়ে লাফায় না। পেছনে যারা ছিল, তারাও কেউ হুটোপাটি করে নামে না। নাউছার আলম আস্তে-আস্তে নৌকো থেকে মাটিতে নামে। নেমে নৌকোর দিকে তাকিয়ে হেসে যেন ধন্যবাদ দেয়, বুড়া মানষি, আর লাফাঝাপা করিবার না পারি, আসেন, নামেন এ্যালায় সব। ততক্ষণে যে যার মোট তুলে নিয়েছে। সবাই একে-একে নামতে শুরু করে।
যোগানন্দ পেছনের দিকে ছিল। সে ধীরেধীরে নামে। হাটে তার কোনো কেনা-বেচারকাজ নেই। মাঝে-মাঝে হাটে এলে সবার সঙ্গে দেখাশোনা হয়, কথাবার্তা হয়, দেশগায়ের ভাব বোঝা যায়। তা সে কথাবার্তা ত খেয়ানৌকোর ওপরও হতে পারে, নেমে পড়েও হতে পারে।
এছাড়াও অবশ্য যোগানন্দের অন্য একটা ভয় ছিল। যদি নাউছার আলম তার সঙ্গে চলতে শুরু করে তা হলে ত সে আর-কিছু করতে পারবে না। কিন্তু হাটসুষ্ঠু লোক দেখবে যোগানন্দ এখন নাউছার আলমের সঙ্গে হাটে আসে। সেটা সে চায় না। সে নাউছার আলমকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেয়।
কিন্তু পাড়ে উঠে দেখে পাকা রাস্তায় রিক্সার ওপর নাউছার আলম বসে এদিকে তাকিয়ে। চোখ ফেরানোরও কোনো উপায় নেই। কাছে যেতেই নাউছার বলে, কী মন্ত্রীমশাই, আর ত রিক্সা নাই এইঠে, আপনি কি মোর পাকে আসিবেন, নাকি এদিকে কামকাজ আছে?
নাউছার আলমও কি তার সঙ্গে যেতে চায় না, নাকি? না, আপনি যান, আমার একটু দেরি হবে। খালপাড়াঠে একোজনের আসিবার কথা।
আচ্ছা, আচ্ছা। নাউছার জবাব দিতেই রিক্সাওয়ালা চালাতে শুরু করে দেয়। নাউছার আলম যেন সব সময়ই আইন মেনে চলে। আর-একটা রিক্সা থাকলে সে যোগানন্দের জন্যে পাড়াত না। কিন্তু তাই বলে যোগানন্দকে সে জোর করে ধরে তার রিক্সাতে তুলবে না। তার সঙ্গে রিয়ায় যাওয়ায় মন্ত্রীর যে-অসুবিধা তাও যেন নাউছার বোঝে। কিন্তু সে ডাকলে ত যোগানন্দ না করতে পারবে না। তাই কথার মধ্যেই ফাঁক রেখে দেয়ইচ্ছে করলে যোগানন্দ না-ও আসতে পারে। কিন্তু মাত্র একটা রিক্সা আছে দেখেও নাউছার আলম চলে যেতে পারে না, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হয় কতকাল আগের মাস-তিনেকের এক সরকারের মাস-দু-একের মন্ত্রীর জন্য। এই ঘাট থেকে হাটটা খানিকটা হাঁটা পথ। কিন্তু এপারে লোকজনের চলমান ভিড়টা জমাট বাধে না। এদিককার নানা টাড়ির, গায়ের, লোকজন হাটের দিকে চলেছে। মাঠঘাট দিয়ে অনেককেই চলতে দেখা যায়। নানা রাস্তা, নানা মাঠঘাট দিয়ে, সব দিক থেকে সবারই যেন এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছনোর তাড়া, যে যার মত। গো-প্রজনন আর হলকা ক্যাম্প-ও কখন একসময় সেই রাস্তার ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাটের দিকেই ছুটেছে।
.
০০৩.
‘সত্যমেব জয়তে’
পিঠে হলকা ক্যাম্পের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রিয়নাথ একটু এগিয়ে দেখল তাদের জিপ গাড়িটা এসেছে কি না! আসে নি। আসার কথাও নয় সন্ধ্যার আগে। সুতরাং সাইনবোর্ডসহ তার থলিটা পাশে নামিয়ে সে চা-মিষ্টির দোকানটার রাস্তার পাশের বেঞ্চিটাতে বসল। তার পেছনে চিতা-সাইজের দুই উনুনে, মানুষ ভাজা যায় এমন দুটো কড়াইয়ে নিমকি ভেজে পাশের ঝুড়িতে ফেলা হচ্ছে। সেঝুড়িটা উল্টে নিলে হাত-পা গুটিয়ে ভিতরে ঢুকে থাকা যায়। ঝুড়িটা একটা সাইজমাফিক গামলার ওপর বসানো–তেল যাতে চুঁইয়ে যায়। ভাজা নিমকির গন্ধ নাকে এসে লাগে। তার পেছনে ঐ উনুনের সামনে লম্বা টেবিলে একটা বছর চোদ্দর ছেলে খালি গায়ে চা বানিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়নাথ তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদা, দুটা নিমকি, একটা চা।
আগামীকাল থেকে চা-নিমকি প্রিয়নাথ নিজের পয়সায় খাবে না। আগামীকাল কেন, আজ একটু পরে হাটে ঢোলাই দেয়ার পরই, আর তাকে নিজের পয়সায় চা-মিষ্টি-সিগারেট খেতে হবে না। হয়ত এই দোকানিই তাকে ডেকে-ডেকে খাওয়াবে। আজকাল ত ঘোষরাই জমি কেন বেশি। এখন গিয়ে এই সাইনবোর্ডটা দেখালে এই নিমকি-চাটাও বিনে পয়সায় হতে পারে। কিন্তু তা সে করতে যাবে কেন? সে ত সরকারি লোক। সেটেলমেন্টের পিয়ন। তাকে দুটো-তিনটে দোকান সাধবে, দু-তিনজন লোক পেছনে-পেছনে ঘুরবে, তবে, সে একজনের কাছ থেকে চা খেলেও খেতে পারে।
কাল থেকে এখানে হলকা ক্যাম্প বসবে। সে-খবর এখানকার সবাইই জানে। ফর্ম এর ইস্তাহার আগেই বিলি করা হয়ে গেছে, ৫৬ ধারার নোটিশও জারি করা হয়ে গেছে–আপন আপন পর্চা জমাবন্দি থাকিলে তাহা সহ উল্লিখিত মৌজায় হাজির হইয়া…। খানাপুরি বুঝারতের নোটিশও পড়েছে। আজকের হাটে একটা ঢোলাই দিতে হবে। সেই জন্য প্রিয়নাথ আগে চলে এসেছে। সাহেব তাকে বলেছিলেন, আমাদের সঙ্গে জিপেই চলুন, আমরা না হয় একটু আগে-আগে বেরব। কিন্তু সাহেবদের জিপে এলে প্রিয়নাথ বাসে আসার টি. এটা পেত না। সাইনবোর্ডটা এনেছে বলে রিক্সাভাড়া বাবদ এক টাকা তার প্রাপ্য। সেটাও পেত না। আর হাটে ঢোলাই বাবদ তিন টাকা–সবসুদ্ধ টাকা পাঁচেক তার ক্ষতি হত। সুতরাং সে যে রাস্তায় বাসে নেমে হেঁটে এল, সাহেবরা সেই রাস্তায় সোজ গিয়ে বয়ে ঘুরে মাল-ওদলাবাড়ি হয়ে আবার বায়ে ঘুরে মোট মাইল বিশেকের পাক দিয়ে এখানে আসবে।