এখন এই রাস্তা জুড়ে সেই শেষ হাটার যাত্রীরা চলেছে–
পয়লা হাটাত দোকানিয়া বেচে
মাঝা হাটাত দেউনিয়া বেচে
শেষো হাটাত ঘরুয়া বেচে।
হাটের প্রথমে ব্যবসায়ীদের বড় বড় কেনাবেচা শেষ হয়ে যায়। তখনই হাটের সারা দিনের দরদাম ঠিক হয়, পাট-তামাক এই সব কত করে যাবে। আজকাল ধান-চালের ত আর বড় কেনাবেচা হয় না–তার দামও আর এই সব হাটের ওপর ওঠানামা করে না। বড় বড় কেনাবেচা হয়ে গেলে গরুর গাড়িতে, আজকাল ত তেমন-তেমন সময় ট্রাকও আসে, মাল সারাদিন ধরে যেতে থাকে।
হাটের মাঝবেলায় আসে জোতদার-দেউনিয়া। সংসারের জিনিশও কেনে, চাষ-আবাদের জিনিশও কেনে। আবার বেচেও দেয় সংসার আর চাষ-আবাদের নানা জিনিশ। আর একেবারে শেষ হাটে আসে ঘর-গেরস্থালির মানুষ জিনিশ বেচতে–একটা কুমড়ো, একটা হাঁস, চারটি ডিম, একটা খাশি–এই সব।
এখন এই রাস্তাটুকু দিয়ে সেই শেষ হাট চলছে। চলতে গেলেই লাইন বাধা হয়ে যায়। আর লাইন বাধা হয়ে যায় বলেই আকাশের দিকে ফেরানো কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র’, আর পিঠে-ঝোলানো হলকা ক্যাম্প যেন এই পুরো লাইনটিরই পরিচয় হয়ে উঠতে চায়। যেন, এই পুরো লাইনটাই গিয়ে ঢুকবে গো-প্রজননের কৃত্রিম ব্যবস্থায় বা, সেটলমেন্টের হলকা ক্যাম্পে।
.
০০২.
ন্যাওড়া নদীর খেয়া
গাছগাছালি, বনবাদাড়ের ভেতর দিয়ে দিয়ে এই পাকা রাস্তাটা শেষ হয়ে যায় নদীর পাড়ে। ন্যাড়া নদী। খেয়াটা ছাড়ছে। খেয়ায় উঠতে মাঝখানে আর-একটা হাঁটুজল পেরতে হবে। সবাই সাইনবোর্ড টাঙানো লাইন ভেঙে, গড় গড় করে গড়ান বেয়ে নেমে, হে-ই’ হে-ই করতে করতে শেয়ার দিকে ছু চলে। খাশিটাকে মুহূর্তে লোকটা কাঁধে তুলে নেয় আর কাঁধে উঠেই খাশিটা লেজ তুলে নাদি-কোতে থাকে, যেন অপেক্ষাতেই ছিল। লোকটাও যেন জানতই। কাঁধের ওপর এমন ভাবে খাশির চার পা গুটনো যে নাদিগুলো সবই বাইরে পড়ে, লোকটির গায়ে লাগে না। লোকটির গায়ে নাদি ফেলতে না পেরেই খাশিটা তারস্বরে চিৎকার তুলে শরীর ঝাঁকানোর ষ্টো করে যাতে কাধ থেকে ছিটকে যেতে পারে। কিন্তু লোকটি কাঁধের ওপর দুই হাতে খাশিটির চার পা আঁকড়ে লাফিয়ে গিয়ে খেয়ায় ওঠে। সাইনবোর্ড দুটো নিয়ে লোকদুটিও এমন ছোটে যে মুহূর্তে মনে হয়, তারা বুঝি এই সাইনবোর্ড-দুটিই বেচতে যাচ্ছে হাটে, যেন এখন এই সাইনবোর্ড-বেচার সিজন।
কিন্তু বড় সাইনবোর্ডটা নৌকার ওপর খাড়া দাঁড় করানো হলে, আর ছোট সাইনবোর্ডটা পিঠেই ঝুলিয়ে লোকটি দাঁড়ালে মনে হয় সত্যিই পুরো নৌকোটা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র’ ও হলকা ক্যাম্প।
লোকটা ত ঘাট থেকে নৌকো আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। এদের চিৎকারে লগিটা আর ঠেলে নি। এরা পাড়ের জলকাদা ডিঙিয়ে এসে কোনোরকমে নৌকোয় উঠেছে। নৌকোর পাটাতন ভেজাই ছিল। এরা আরো একটু ভেজায়। সবাই উঠতেও পারে নি। কিন্তু তোক বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে মাঝি লগি ঠেলে নৌকোটা সরিয়ে নিয়েছে। লগির আর দু-এক ঠেলাতেই ত ওপারে পৌঁছে যাওয়া যাবে–এতই ছোট নদী। হয়ত হেঁটেও পার হওয়া যায় কোথাও-কোথাও। কিন্তু সব জায়গায় ত সব সময় এক জল থাকে না। আবার ওপর থেকে ছোটখাট বানও এসে থাকতে পারে। সেই কারণেই নৌকোয় পার হওয়া।
নৌকোয় সবাইই দাঁড়িয়ে। তার মধ্যেই এদিককার সবচেয়ে বড় জোতদার নাউছার আলম। ওয়াকফ এস্টেটের মালিক। হাজার-হাজার বিঘার চুকানদার। ডুয়ার্স যখন প্রথম বন্দোবস্ত দেয়া হয় তখন থেকে নাউছার আলমরা এখানকার সব জমির মালিক। খাশ জমির আইন পাশ হওয়ার পর গত পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর ধরে নাউছার আলমের সঙ্গে সরকারের মামলা লেগেই আছে। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত অনেকগুলি কেস গিয়েছে, তার অনেকগুলোতে আলম জিতেছে, সরকার হেরেছে। তা ছাড়া অসংখ্য জমিতে ইনজাংশন হয়ে আছে দশবার-পনের-বিশ বছর। ইনজাংশনের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত সেই সমস্ত জমির ফসল আলমের গোলাতেই উঠছে। সরকার আলমের জমির ঘাসও ছুঁতে পারে নি–এরকমই সবার ধারণা। আলমের জমির কোনো-কোনো অংশে আধিয়াররা মাঝে-মধ্যে ভাগ দেয় নি বা সরকারের কাছে জমির পাট্টা চেয়েছে। কখনো পেয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে তেমন ঘটনা খুব বেশি নয়। নাউছার আলম লোকটি বেঁটেখাট। শাদা হাফশার্ট আর ছোট মাপের একটা পায়জামা পরনে। হাতে ছাতা। সবাইই সেলাম দিচ্ছে। নাউছারও তাদের সেলাম জানাচ্ছে। নাম ধরে ধরে সবার খোঁজখবর করছে। এদিককার বড় বড় সব হাটে নাউছার কিছুক্ষণের জন্য গিয়ে বসে। সবার সঙ্গে দেখাশোনা খোঁজখবর হয়।
নাউছারের কাছেই, কিন্তু একটু যেন দূরত্ব রেখে, দাঁড়িয়ে যোগানন্দ মন্ত্রী। প্রফুল্ল ঘোষ যখন মাস তিনেকের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল–প্রথম যুক্তফ্রন্টের পর, তখন যোগানও মন্ত্রী ছিল; বোধ হয় মাস-দুই। তার পর থেকে তার নামই হয়ে আছে যোগানন্দ মন্ত্রী। ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে যোগানন্দও ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে। নাউছার আলম যোগানন্দকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে, মন্ত্রীমশাই, ঐ বড় সাইনবোর্ডে কী লিখা আছে? যোগানন্দ আগেই দেখেছিল। বলল, ঐ হরিয়ানার বলদের–
ও, নাউছার বুঝে যায়। এ অঞ্চলে সেইই প্রথম কৃত্রিম গো-প্রজনন শুরু করেছিল–তাও বছর কয় আগে। এখন তার বাথানে ত হরিয়ানা ছাড়া অন্য কোনো গরু নেই বললেই চলে। বাসে যেতে-যেতেও ফরেস্টের পাশের জমিতে মোষের সাইজের গরু চরতে দেখলে অনেকেই বলে দিতে পারে, নাউছারের গরু। নাউছার আবার জিজ্ঞাসা করে, আর ঐঠে কী লিখা মন্ত্রীমশাই, ঐ যে মানষিটার পিঠত?