নানা উচ্চতার আর বেধের ছায়া যত স্পষ্ট হচ্ছিল-নীচটা যেন ততই হয়ে উঠছিল অস্পষ্ট, অন্ধকার। সেই নাচের মাঠ, সদর রাস্তা আর হাটে ঢুকবার নানা গলিখুঁজিতে অন্ধকারটা একটু বেশি জমাট বাধা। উঁচুতে, দিগন্তে এত বেশি নতুন নতুন ছায়ার মাথা যে সেই গোড়ার অন্ধকারটা যেন আরো তলানিতে পড়ে যায়।
মাঠটার ভেতরে সেই তলানিটুকু আলোড়িত হয়ে উঠছিল। অবশ্য আকাশের দিগন্তের, নীরব অথচ দ্রুত ছায়াময় বদলের অনুষঙ্গেই মনে হতে পারে তলার এই অন্ধকারও বদলাচ্ছে। রাত্রি ও অন্ধকার ত সবটুকু ব্যেপেই রয়েছে। তাই তার এক সীমান্তের আলোড়ন হয়ত আরেক সীমায় ঢেউ তোলে, ক্ষীণ।
জলের ভেতরের কোনো আলোড়ন যেমন সেই জায়গার ভেতর থেকে জলটুকুকে আলোড়িত করে–অন্ধকারটাও তেমন হচ্ছিল। একটা গোঙানিও যেন শোনা যায়–তবে রাত্রিতে ত কত রকমই আওয়াজ ওঠে।
আলোড়নটা যে অন্ধকারের নয় ও আওয়াজটাও যে শুধু রাত্রিরই নয়–সেটা বোঝাতেই ঐ অন্ধকারটা ধীরে ধীরে একটা কঠিন আলোড়নের আকার নেয়, গভীর নিভৃতিতে বাঘিনীর একা-একা খেলায় যেমন আলোড়ন ওঠে ঝোঁপঝাড়ে। তারপর সেই অন্ধকারটা ফুড়ে একটা মানুষের দাঁড়ানোর নানা চেষ্টা আর বারবারই পড়ে যাওয়া ঘটতে থাকে-নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া ডুবো মানুষের যেমন হাবুডুবু দেখা যায়। তার দাঁড়িয়ে ওঠাটাই যেন একটা কঠিন কাজ হয়ে ওঠে তার পক্ষে, যেমন সার্কাস-দেখানো যে-কোনো চারপেয়ে পশুরই হয়। কী অসম্ভব কষ্টে তাকে দু-পায়ের ওপর দাঁড়াবার চেষ্টা করে, আবার ভেঙে যেতে হয় নিজের শয়ান অস্তিত্বে।
এমনি করে এক সময় লোকটি দাঁড়িয়েই ওঠে। দাঁড়িয়েই থাকে তার গায়ে অন্ধকারের এক পুরু পলেস্তারা লাগিয়ে। দাঁড়িয়ে থাকে আর টলে। তাতে অন্ধকারটা টলে না অবশ্য, কিন্তু অন্ধকারের গাঢ়তার একটা তারতম্য ঘটে। তারতম্যের সেই সামান্য তফাতেই লোকটির ভঙ্গির আভাস মেলে–তা ছাড়া সবটাই ত ছায়া। পটভূমির ছায়ার লাইনটার ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে একটু আকাশ, তার মাথার ওপর তোলা দুই হাতের দশটি আঙুল আর মাথার চুলের ছায়াময় রেখাগুলিকে প্রখর করছিল। সেখানেও, ডুবো মানুষের মতই, লোকটি হাতটাই নাড়ায়।
লোকটি দাঁড়িয়ে ওঠার পর আর-কোনো গোঙানি শোনা যায় না। যেন, গোঙানিটা এতক্ষণ ছিল তার দাঁড়িয়ে ওঠার চেষ্টারই আনুষঙ্গিক আর, দাঁড়িয়ে ওঠার পর, দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টায় সে কোনো আওয়াজই করছিল না।
অনেকক্ষণ পর, মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বললে যেমন আত্মগত আওয়াজ বেরয় গলা দিয়ে, তেমনি স্বরে লোকটি ডাকে, হু-জ-উর। সে এই ডাকটি ডাকার আগেই তার গলায় একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ উঠেছিল। ডাকটি শেষ হয়ে গেলেও আওয়াজটি থাকে। জোরে ঢোক গিলে সেই আওয়াজটাকে বন্ধ করে। জোরে ঢোক গিলতে গিয়ে তাকে গলার ভেতরে যে-অতিরিক্ত জোর চালান করতে হয়, তাতেই তার ঘাড়টা তার বুকের ওপর ঝুলে পড়ে। ওরকম ঝুলেই থাকে, যেন মাথাটা তার মাথা নয়, গলার লকেট।
দুমড়ে-মুচড়ে গলাটাকে শক্ত করে সে তোলে। বেশি নাড়ায় না, পাছে আবার স্কুলে যায়। শক্ত অবস্থাতেই সামনে জোরে হাঁক দেয় হাকিম। দ্বিতীয় হাঁক দিতে পারে না। তা হলেই মাথাটা মুচড়ে ভেঙে যাবে, মাথাটা শক্ত রাখা দরকার। কিন্তু মাথা আর শক্ত রাখা যায় কতক্ষণ। সেটা যখন নিজের ভারেই নুয়ে ঝুলে পড়তে চায় বুকের ওপর, তখন লোকটি মাথাটা জোর করে পেছনে ভেঙে দেয় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকে, সাহেব।
লোকটি যেন তার হুজুর-হাকিম সাহেবের আকাশ থেকে নেমে আসাটা দেখে। বেশ কিছুটা সময় লাগে ত আকাশ থেকে নামতে। কিন্তু তার হকিম মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ত আর সে ঘাড় সোজা করে হাকিমকে দেখতে পারে না। তাকে ঘাড় তুলতে সময় নিতে হয়। তুলে,সে অন্ধকারের মধ্যে হুজুরকে ঘেঁজে–এদিকে-ওদিকে, এ-কোনায় ও-কোনায়, তারপর একদিকে সোজা কয়েক পা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, হুজুর, মুই আসি গেছু, মুই ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন।
ফরেস্টার তার দুটি হাত জোড়া করতে চায়। কিন্তু সেটা কিছুতেই হয়ে উঠতে পারে না। দুটো হাতের যেন দুধরনের গতি ও ভার। বাঁ হাতটা ওঠে ত ডান হাতটা ওঠেই না। বা হাতটাকে নমস্কারের ভঙ্গিতে অনেকখানি তুলে ফরেস্টার চোখ কুঁচকে দেখে তার ডান হাতটি নেই, চোখটা আরো পাকিয়ে সে যেন বুঝে উঠতে চায়, ডান হাতটা গেল কোথায়। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেহাতই অকস্মাৎ তার ডান পাশে সেই হাতটাকে খুঁজে পায়। তখন সেই হাতটাকে বা হাতের কাছে আনার জন্যে তুলতে থাকে। তাকিয়ে-তাকিয়ে একটু-একটু করে। এদিকে বা হাত আবার স্কুলে যেতে থাকে। কিছুটা ঝুলে যাওয়ার পর সেটাও ফরেস্টারের নজরে পড়ে। সে তখন দুটো হাতকেই স্থির করে একবার বা, আর একবার ডান হাতের দিকে তাকায়। এরকম বারদুয়েক তাকানোর পর আর দেরি না করে সে হঠাৎ দুটো হাতকেই নমস্কারের জায়গায় টেনে নিয়ে আসে। একটু বাকাচোরা ভাবে দুটো হাতই জোড়া লেগে গেলে ফরেস্টার সেই জোড়াহাতের দিকে তাকিয়ে খুব হাসে, যেন সে দুই হাতের গোলমাল ঠেকিয়ে দুই হাতকে খুব জব্দ করতে পেরেছে। আপন মনে হাসতে-হাসতে জোড়াহাতের দিকে তাকিয়ে ফরেস্টার বল, লায়? বলে, আবার হাসে।