কিন্তু সুহাসের বিরক্তিটা বাড়ে এই কারণে যে বিকল্পটাও সে বুঝতে পারে না। সে কি এখন হাট কমিটির জোতদার আর চা বাগানের ম্যানেজারদের বাড়িতে বা বাংলোয় গেস্ট হয়ে, এখানকার জমিজমার বেআইনি দখল বা আইনি দখল বা জমির আইনসঙ্গত পরিমাণ এই সব নির্ণয় করবে? আবার, এখানেও সুহাস আর-এক প্যাঁচে পড়ে যায়–সে কি সেটলমেন্টের অফিসার হয়ে এসে এই এলাকায় ভূমি-বিপ্লব ঘটাচ্ছে না-কি? তার কাজ ত রেকর্ড করা। রেকর্ড করার সময় দু-এক জায়গায় হয়ত সত্যনির্ধারণে তার বুদ্ধি বা বিবেচনাশক্তি, বা তার চাইতেও বেশি, ইচ্ছাশক্তি দরকার হতে পারে। এবার আছে বর্গাদার রেকর্ডিং। কিন্তু কেউ রেকর্ড করাতে চাইলে সে রেকর্ড করবে। সুহাস খুব ভালই জানে জমিব ওপর আধিয়ারের দখলটা যেখানে নির্ভর করে জোতদারেরই ওপর–নিজের বা নিজের মতই আরো অনেকের দখলবোধের ওপর নয়–সেখানে বর্গাদার রেকর্ডিং করাতে জোতদারও আসে না, বর্গাদারও আসে না। অপারেশন বর্গা ত সরকারের একটা আইন-যা আরো নানা আইনের মত ফাঁকি দিতে হয়।
এত জেনেশুনেবুঝেও সুহাস এই মাল এলাকা নিয়ে এত ম্যাপট্যাপ দেখে, একে, সেনসাস রিপোর্ট-টিপোর্ট ঘেটে, এত-এত তৈরি হল কেন।
এই মধ্যরাত্রিতে সুহাসের নিজের কাছেই নিজের এই দ্বিচারণ যে ধরা পড়ে যায়, সে কারণেই সে বিরক্ত হয়ে ওঠে। তার কোনো ক্ষমতা নেই জেনেও, আর এই সব রেকর্ডিং করে কিছু সমাধান সম্ভব ..নয় জেনেও, সে ত নিজেকে তৈরি করেছে যদি কিছু করা যায় তার জন্যেই।
সুহাস কি তা হলে বেঁচে যেত যদি সে নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা নিজে করে নিত আর অফিসের কর্মচারীরা চিরকাল যা হয়ে আসছে তেমন ব্যবস্থাই মেনে নিতেন? কিন্তু জোতদার বা চা বাগান ত আর বিনা স্বার্থে লোকগুলোকে খাওয়াত না। তা হলে ত এই কর্মচারীরাই তার হাত দিয়ে চাবাগান আর জোতদারের কাজগুলো করিয়ে নিত। সব কিছুতে, সরকারেসংগঠনে-আইনে ও তার ব্যক্তিগত ভূমিকাতে, যতই অবিশ্বাস করুক সুহাস-তার হাত দিয়ে জোতদার আর চা বাগান কলকে খাবে এটা সে মেনে নেয় কী করে?
কিন্তু তার সততাপনায় বাধ্য হয়ে এই কম মাইনের কর্মচারীরা তাদের ডেইলি অ্যালাউন্সের টাকা কটা বাঁচাতে পারবেন না; অথচ একসঙ্গে এতগুলো টাকা পাওয়া যাবে বলে হয়ত খরচ-খরচার একটা প্ল্যানও তারা পরিবারে ছকে রেখেছেন। এই আত্মত্যাগ করে যাওয়ার জন্যে আদর্শের যে-ডোজ অবিরত দিয়ে যাওয়া দরকার তা সুহাস পাবে কোথায়? আর দেবেই বা কেন? তাহলে কি উচিত হয়েছে ওদের এতটা ক্ষতি করা? সুহাস ত ওঁদের চাইতে অনেক বেশি মাইনে পায়। তার ডেইলি অ্যালাউন্সও অনেক বেশি। তার বেশি টাকা মাইনের বেশি সুযোগ-সুবিধেয়, কম পারিবারিক খরচার ফাঁকে, একটু বাড়তি টাকা থাকে বলেই কি সুহাস নৈতিকতায় আদর্শস্থল হয়ে ওঠার দম্ভ দেখায় তার অধস্তন কর্মচারীদের সামনে?
এর সঙ্গে-সঙ্গে সুহাসকে আর-একটা সন্দেহে জড়িয়ে পড়তে হয়। অফিসের কর্মচারীরা অ্যান্টি করাপসন ড্রাইভ-এ যেমন তাকে সমর্থন দিতে বাধ্য, তেমনি সেই কারণে যে-আর্থিক ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে তুলতে অন্য কোনো ব্যবস্থা কি নেবে না? শুধু খেলে ত না হয় গৃহকর্তার কাজটুকু করে দেয়ার থাকত। এখন কি ঘুষ আগে ব্যাপক হয়ে উঠবে না? অর্থাৎ সুহাসের হাত দিয়ে অনেক বেশি কলকে খাওয়ার চেষ্টা হবে না? তা হলে, সুহাসকে কতদিকে চোখ রাখতে হবে? কোন দিকে? একটা দিকের দায় মেটাতে সুহাস নিজেকে আরো কত প্যাঁচে জড়িয়ে ফেলল? আর, সুহাসের যাতে গা ঘুলিয়ে ওঠে, সেই ব্যক্তিগত নীতিবায়ুতেই কি সে জড়িয়ে পড়ল তার অফিস-টফিস সমেত? কিন্তু এত আবার অফিসার হিশেবেও তার করণীয় বা কর্তব্য–বেঙ্গল সার্ভিস রুল বা ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট হ্যান্ডবুকে নির্ধারিত। শেষে, সুহাস কি তার ব্যক্তিগত নীতিবায়ুজনিত আত্মদ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যুরোক্রেসির নীতিতন্ত্রের নৈর্ব্যক্তিকে পরিত্রাণ খোঁজে, এই মধ্যরাতে, তেতো মনে? যেন, অফিসার বলেই তার আচার-আচরণের দ্বারাই সৎ-অসৎ, ভাল-মন্দ নির্ধারিত হবে? সে রান্না করে খাবে বলেই এরাও রান্না করে খাবেন? আমলাগিরির এমন নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থার মধ্যে সুহাস এমন ফিট হয়ে যাচ্ছে কেমন করে? নাকি, সাহেবদের তৈরি ব্যবস্থায় এমনি ভাবেই ফিট হয়ে যেতে হয়? সুহাসের চাকরি জীবনের এই প্রথম ক্যাম্পেই।
.
০১৪.
ফরেস্টারচন্দ্রের আত্মঘোষণা
এখন এই মাঠটা একটু স্পষ্ট। হাটখোলার চালা আর ঘরগুলো মিলে ছায়ার একটা নকশাও তৈরি হচ্ছে। সেই নকশাটা ধীরে-ধীরে বোনা হচ্ছে–আকাশের পটভূমিতে। ধীরে-ধীরে সেই নকশার কারিকুরি বাড়ছে, বিস্তার বাড়ছে। ঝোঁপঝাড়, ফাঁক-ফুকর–সেই নকশার ভেতর এসে যাচ্ছে। ধীরে-ধীরে এসে যাচ্ছে দূরের, প্রায় দিগন্তরেখার গাছ-গাছালি। আর তারও পরে, বড়বড় গাছের মাথা। এখন, এই সমস্ত পরিবেশটাকেই নানা ধরনের ও দূরত্বের ছায়া দিয়ে-দিয়েই আন্দাজ করা যায়। ছায়াগুলো এত ধীরে-ধীরে বাড়ে আর ছড়ায়, ধীরে এত বেশি দূরত্ব ছায়ায়-ছায়ায় আভাসিত হয়, যেন, যে-কোনো মুহূর্তে এই স্থির ছায়া চঞ্চল হয়ে উঠতে পারে বা, এই স্থির ছায়াগুলির ভেতর দিয়ে কোনো চলচ্ছায়া চলে গিয়ে ছায়াময় পরিস্থিতিকে জ্যান্ত করে তুলতে পারে।