সেই অশ্বারোহী ও তার ঘোড়া এখন শূন্য হাটে পাক খায়। ঘোড়াটার পেছনটা এখন ঝোড়ো বাতাসে দোল খাওয়া চালাঘরের মত, আরো ঘন-ঘন দোল খাচ্ছে। এর পরই যে-কোনে সময় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। ঘোড়র পেছনটাই শুধু দেখা যায়–তার দুটো পায়ের কেমন অনেকগুলো ভাজ বা পেছনের হাড় দুটো উঁচু। লেজটা দুই পায়ের মাঝখানে নেতিয়ে ঝুলে, মাছি তাড়াবার জন্যও আর উঠবে না, এমন। ঘোড়ার সামনেটা আর ঘোড়ার নয়। অশ্বারোহী দুই হাতে ঘোড়ার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে মাথাটা ঝুলিয়ে বসে। সেই চাপে ঘোড়ার গলাটা লম্বা হয়ে ঝুলে গেছে। ক্রমেই গলাটা আরো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ঘোড়াটি গলা লম্বা করে ঝুলিয়ে দিয়েও ঘাসে মুখ দেয় না। তার পিঠের ওপর নিজেরই ঘাড়ের ভেতর মাথা গুঁজে দেয় অশ্বারোহী আর লম্বা করে দেয়া গলার তুলনায় ঘোড়াটার নড়বড়ে পেছনটাকে কেমন হালকা লাগে, যেন মাথাঘাড়সমেত ঘোড়াটা কোনো ফাঁদ গলায় নিয়েছে, আর এখন শুধু পেছনের অংশটুকুই তার নিজের।
সেই ঘোড়া আর তার আরোহী এখন এই শূন্য হাটের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ায়, যেন এখনো সেখানে হাট, যেন এখনো তাদের মানুষজন ঠেলে-ঠেলেই এগতে হচ্ছে। কিন্তু এখন আর অশ্বারোহী তার ভিক্ষার ঝুলি কাঠির ডগায় ঝুলিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে না। এখন আর ঘোড়াটিকে পেছনে ধাক্কা খাওয়ায় চমকে উঠতে হয় না। আর অস্পষ্ট চাঁদনিতে সেই ঘোড়া আর অশ্বারোহী ঘুমুতে-ঘুমুতে প্রায় নির্জন হাটের অলিগলি দিয়ে পাক খেতে-খেতে যেন মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে বস্তির দিকেই চলেছে। এতে পারে, এই অশ্বারোহী অন্ধ। হতে পারে, এই ঘোড়াটি অন্ধ। হতে পারে, এই ঘোড়া আর অশ্বারোহী দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো এক সময় পথ পেয়ে যাবে–তারপর আকাশের পটভূমিতে, নদীর চর ও অরণ্যের দূরত্বকে এই ঘোড়া আর তার আরোহী আদিগন্ত প্রান্তরের আলে-আলে কমিয়ে আনবে। ভাদ্রের আকাশের ধূসরতায়, নীল আর প্রান্তরের সবুজে, অরণ্যের কৃষ্ণাভ হরিতে এই ঘোড়া ও তার আরোহী কখনো মিশে যাবে, কখনো ঘোড়াটির লম্বিত গলাটিই ঝুলে থাকবে, কখনো ঘাড়ের ভেতর গুঁজে যাওয়া মাথা নিয়ে আরোহীর ছায়াটুকু ভেসে থাকবে, কখনো ঘোড়ার পেছনটা একটা ভাঙা মেশিনের মত লাফাতে লাফাতে যাবে–যেন কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কখনো নদীর দুই পাড়ে ছায়া–মাঝখানের জলটুকুতে ওদের ছায়া, কখনো জলহীন নদীখাতটুকু যেন ঘোড়ার চারটি পায়ের ভঙ্গুরতা থেকে উজিয়ে গেছে, কখনো নদীর বাঁধের ওপর ছায়ায়-আলোয়, নদীর ভিতর-চরে বালিয়াড়ি ভেঙে, বা অরণ্যের কোনো গাছতলায়। এখন মধ্যরাত্রিতে এই শূন্য হাটে বোঝা যায় না, এই ঘোড়া ও তার আরোহীর কোথাও একটা অবতরণ আছে।
বিকেল আর সন্ধ্যার সব দৃশ্য এখন রাত্তির গভীরতায় ছায়ামূর্তি হয়ে যাচ্ছে। যেন, নদী বা পাহাড়পর্বত বা বনজঙ্গলের মত এই হাটখোলাও একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। যতক্ষণ এই হাটখোলায় মানুষজন ছিল, আলো ছিল, চঞ্চল ছায়া ছিল, পশু ও মানুষের আহ্বান ছিল–ততক্ষণ তার বিস্তার ছিল না, যেন সমস্ত দৃশ্যটাই ছিল সংহত, একান্ত। এখন, মধ্যরাত্রিরও পরে, এই জনহীনতায়, এই নৈঃশব্দ্যে, এই হাটখোলার প্রান্তর যেন তার প্রাকৃতিক বিস্তারে ফিরে যাচ্ছে–ধীরে-ধীরে, প্রায় কোনো সজীব অস্তিত্বের অনিবার্যতায়। এখন, এই রাত্রি আর অন্ধকারের ভেতর থেকে সারাদিনের সেই ব্যস্ততাকেই কেমন অলীক ঠেকতে পারে।
কিন্তু হাটটা এখন সম্পূর্ণ জনশূন্যও নয়। অত পাহাড়-পাহাড় মাল সবই কি ফেরত গেছে। কিছু হয়ত আছে, কাল সকালে যাবে। সেই যে প্রায় শেষহীন মাটির হাঁড়ি। আর অন্ধকার থেকে গো-হাটার গরুর হাম্বা। সারা হাটে, সেই হাটের পেছনের আপাত গোপন হাটেও, এখানে-ওখানে ঝরে পড়ে আছে দু-একজন মাতোয়ালা মানুষ এখন অন্ধকারে তাদের গায়ের চামড়ার তামা বা কাল মিশে গেছে, নাকের মোঙ্গলীয় খর্বতা আর অস্ট্রিক শান হারিয়ে গেছে, তাদের কুঞ্চিত বা স্বল্প সরল চুলে ঢাকা মাথার খুলির আকার অন্ধকার থেকে আর আলাদা করা যায় না। আজ সারারাত তাদের ওপর শিশিরপাত ঘটবে অবিরত। ভেতরে-ভেতরে তপ্ত সেই শরীর শিশিরে-শিশিরে ঠাণ্ডা হবে। কাল সকালে, বা রাতেই কখনো, এই মানুষজন তাদের নেশামুক্ত পায়ে আবার ফিরে যাবে পাহাড়ে, নদীর চরে, বনের ভেতরে।
আর এখন এই পুরো প্রকৃতি ছায়াময়–যেমন হয়, যখন উঠে আসার আগে চাঁদ দিগন্তের নীচে, বা, চাঁদকে আড়াল দিতে-দিতে সহসা কোনো পাহাড় বা টিলা উঁচু হয়ে উঠতেই থাকে, বা, মাঝখানে মাইল-মাইল ফরেস্টের ওপারের অববাহিকায় চাঁদ।
.
০১৩.
সাহেবের আত্মবিলাপ
সুহাস বলে ফেলেছিল, যা হক, ক্যাম্পেই রান্না করবে–সেই জন্যই ত শেষ পর্যন্ত জ্যোৎস্নাবাবু-বিনোদবাবুও সেটা মেনে নিলেন। এ যেন, মন্ত্রীদের মত দু-কোপ মাটি কেটে হাড়কালি মেহনতের মানুষজনকে অনুপ্রাণিত করার নামে অপমান। জ্যোৎস্নাবাবু ত তার স্টাফ নন। প্রাইভেট আমিন। বিনোদবাবুদের চেনা লোক। সঙ্গে থাকলে কাজ খুব তাড়াতাড়ি এগয়। পাটিরা ওঁকে দিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে নেয়। কিন্তু কর্মচারীদের সামনে তাকে যে এরকম একটা উদাহরণ হয়ে উঠতে হল এতেই সুহাসের নিজের ওপর এত বিরক্তি। আর, ব্যাপারটা এত আলোচিত-প্রচারিত হওয়ায় যেন একটা নৈতিক কর্মসূচির, না কী যেন, অ্যান্টিকরাপসন ড্রাইভ-এর চেহারা নিল। যেন সুহাস কোন নৈতিকতা বা সংস্কারের প্রয়োজনে এমন একটা ব্যবস্থার কথা বলেছিল!