আর সেই চা বাগান?
সে ত বছর খানেক আগে খুলি গেইছে। ত ফ্যাকটরি ত আর চলে না। গ্রিনটি বেচা হয়া যায়। গোডাউনটা শুকনা লঙ্কারই আছে।
সুহাসের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, আর আলু?
সে ত এই বছরই একখান ঠাণ্ডা ঘর চালু হবা ধরিছে ওদলাবাড়িত।
ওদলাবাড়িতে ত এখানে কী?
সে ত ঠিক বলিবার পারিম না। এইঠেও বুঝি একটা গুদাম থাকিবার পারে।
সুহাস আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল। এখন আস্তে-আস্তে বেরতে শুরু করল। তখন ভদ্রলোক পেছন-পেছন এসে বললেন, আমাদের কথাটা একটু বিবেচনা করি দেখিবেন। এর মধ্যে ত কুনো দোষ নাই। আমাদের বাড়িঘরেরও ত সাগাইকুটুম আছে।
ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু আন্তরিকতা ছিল যার জন্যে সুহাসকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হয়। কিন্তু দোকানের মাঝখানটাতে বড় ভিড়। এদিকের বেঞ্চের একটা বড় দল খাওয়ার পর উঠে পয়সা দিতে যাচ্ছিল–প্রায় লাইন দিয়ে। বোঝাই যাচ্ছিল দলটা আসলে একটাই-ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ফলে সুহাসকে তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়াতে হয়।
ভদ্রলোকও পিছু-পিছু এসে পঁড়ান। সুহাস তখন তাকে বলতে পারে, আপনারা এরকম করে বললে আমারই লজ্জা হয়। হবে-খন, আমরা ত এখন থাকবই।
ভদ্রলোক দুই হাত সামনে নিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে মাথা হেলান।
প্রিয়নাথ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন সুহাসের সঙ্গে আরো দু-চারজন কথা বলছে তখন প্রিয়নাথ এগিয়ে এসে এদের পেছন থেকে বলে, স্যার, আমি ক্যাম্পে এগুলো রেখে আসি?
সকলেই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়নাথকে একবার দেখে নেয়। আর তাদের দেখার সুবিধে করে দেয়ার জন্যেই যেন প্রিয়নাথ তার মুখটা আলোতে মেলে রাখে। এরপর ত তার সঙ্গেই সবাইকে কথা বলতে হবে।
আপনি যান, আমি যাচ্ছি সুহাস প্রিয়নাথকে বলল। তারপর হঠাৎ ভিড়টা সরে গেল। সুহাস ভেবেছে সে এখন চলে যেতে পারে। কিন্তু ফাঁক দিয়ে বেরবার জন্যে পা ফেলতেই খুব ছোটখাট একটা লোক সামনে এসে নমস্কার করে দাঁড়াল, খুবই মৃদু গলায় বলল, আমার নাম নাউছার আলম।
অ্যাঁ! বলে হকচকিয়ে সুহাস প্রতিনমস্কার করতে ভুলে গেল। নাউছার আলম–এই নামটা ত প্রায় গেজেটিয়ারে উঠে গেছে। সরকার বেশির ভাগ কেসেই হেরেছে সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত। বাকি জমিতে ইনজাংশন। নাউছার আলম–এই নাম শুনে যাকে ভেবেছিল ডাকাতের মত পরাক্রান্ত, সে কি না এরকম ছোটখাট ভদ্রলোক। কিন্তু ততক্ষণে অন্য সবার দিকেও ঘুরে-ঘুরে নমস্কার করে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই আচ্ছা চলি বলে ভদ্রলোক ভিড় থেকে বাইরে চলে গেছেন।
.
০১২.
শেষহাটি থেকে হাট শেষ
একটা চরম বিন্দু আছে যখন কোনো কিছুই আর হাটের বাইরে নয়। তখন যে হাটের রাস্তায় আছে, হাটে। এসে পৌঁছয় নি-সে-ও হাটের ভেতরে ঢুকে যায় দূর থেকে। এই একটা সময়, যখন হাটটা যেন তার অব্যবহিত চারপাশের অনির্দিষ্ট সীমাটুকুও উপছে যায়। বেড়ে যাওয়ার ও জমে ওঠার সেই অস্পষ্টতায় হাটটা যেন আর হাটে ধরছে না। এই সময়ই নেমে আসে গোধূলি। মানুষের পায়ের ধুলোয় আবছায়া ঠেকে সব। কোথাও-কোথাও লম্বা কুপি জ্বলে উঠে দীর্ঘ-দীর্ঘতর ছায়ায় ছায়ায় হাটটার ভিড় যেন সহসা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর এই অবস্থাটা কিছুক্ষণ চলতে-চলতেই দেখা যায় সীমান্ত থেকে সীমান্তের দিকে চলে যাওয়া মুখগুলো আর এদিকে ফেরানো নয়, মুখগুলো ঘুরে গেছে, আদিগন্ত পথে-মাঠে মানুষের সারির মুখ এখন কেন্দ্রের বিপরীতে, দিগন্তের দিকে হাট শেষ-ভাঙা ভাঙতে শুরু করে। কখন যেন হাটটা চরমে উঠে মিইয়ে গেল। মানুষজনের পায়ের দাগ বদলে গেল।
হাটে যাওয়ার পথে মানুষজন যত কথা বলে, যেন হাট থেকে ফেরার পথে তার চাইতে অনেক বেশি। নাকি, হাট থেকে ফেরা ত সব সময়ই অন্ধকারে, তখন ত আর মানুষজন পরস্পরকে দেখতে পায় না, তাই কথা বলে বলে আন্দাজ নেয়। কথা বলে বলে পথ বানায়। নাকি, হাট-ভাঙা মানে সমবেত ধ্বনির সেই কেন্দ্রটিই ভাঙা, তার টুকরোগুলো তখন চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। রাত্ৰিময় ধ্বনিমগ্ন পথে-পথে গড়াতে-গড়াতে গুড়ো-গুড়ো হয়ে হাটটা শেষে ধুলোবালি ও আকাশে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে যায়।
হাটের শুরুও শুরু হয় দূরের মানুষ নিয়ে। হাটের শেষও শুরু হয় দূরের মানুষ দিয়েই। যারা বাস ধরবে, তারা সবচেয়ে আগে হাট ছাড়ে। যাদের বাস হাট থেকেই ছাড়ে, তারা তারও পর। রিক্সা যাদের দাঁড়িয়ে থাকে, এর পরই তারা ওঠে। তাদের শেষে, সাইকেলের যাত্রীরা। এই পুরো সময় জুড়েই চলে পায়ের যাত্রীরা-যদিও তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, ক্রমেই বাড়তে থাকে। আর দূর-দূর রাস্তার দূরত্ব থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে আসতে-আসতে শেষ পর্যন্ত হাটের আশেপাশের গগঞ্জের মধ্যে মিশে যায়। সবচেয়ে শেষে আসে, শেষে যায়।
মানুষজন যে-ভাবে হাটে আসে সেভাবেই ত ফেরে, জিনিশপত্রের বোঝা নিয়ে, পশুপাখি ঝুলিয়ে, বা টেনে। মাঝখানে হাটে হাত বদল হয়ে যায়। ধীরে-ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকারে পশুপাখির চোখের সামনের অভ্যস্ত আলো বা অন্ধকার বদলে যায়। সব অনভ্যস্ততেই ত পশুপাখির ভয়। কিন্তু সেই নিরুপায় অন্ধকারে অভ্যাসের একমাত্র ধারাবাহিকতা থাকে মানুষের কণ্ঠস্বরে বা মানুষের স্পর্শে। হাটে আসা-যাওয়ার পথ এই পশুপাখির অনিশ্চয়তার ডাকাডাকিতে মুখর হয়ে যায়। বা পায়রা-হাঁস-মুরগির অনিশ্চিত নীরবতায়। হাম্বা ডাক শুনে কি বলা যায় কোন বাছুর বিক্রি না হয়ে অভ্যস্ত হাতের টানে ফিরে চলে, আর কোন বাছুরের দড়িতে নতুন হাতের নতুন টান?