হাটের সামাজিকতা
সদর রাস্তার দু পাশের দোকানে হ্যাজাক বাতি, ডান হাতিতে একটু দূরে একটা ইন্টার-প্রভিন্সিয়াল ট্রাক দাঁড়ানো। বয়ে চায়ের দোকানগুলিতে লোকজনের ঠাসা ভিড়। ডাইনে-বায়ে তাকিয়ে সুহাস যেন হাটের ম্যাপটা আর-একবার ছকে নেয়।
সুহাস মিষ্টি ও চায়ের দোকানগুলোর দিকে যায়।
বাইরের বেঞ্চিগুলোতেই বসার ইচ্ছে ছিল সুহাসের। কিন্তু সেখানে এখন গাদাগাদি ভিড়। খবরের কাগজের টুকরোর ওপর জিলিপি আর নিমকি। বেশির ভাগই চা বাগানের মজুর-মজুরনি। এদিককার ভাষায় মদেশিয়া। অনেকে, নিজেও খাচ্ছে, কোলের বাচ্চাটিকেও খাওয়াচ্ছে-ভেঙে-ভেঙে।
সুহাসকে ভেতরে গিয়েই বসতে হয়। আর, ভেতরেই যখন বসেছে তখন একেবারে শেষে গিয়ে বসাই ভাল। মাইকাটপ হাইবেঞ্চ। সামনে বেঞ্চিও আছে, কোথাও-কোথাও ভাজ করা চেয়ারও। সুহাস একটা ভাজ করা চেয়ারে আলগা হয়ে বসে। তার সামনের, পাশের সব টেবিলেই লোক। সুহাসের শুধু এক কাপ চা-ই খাওয়ার ইচ্ছে। অথচ বুঝতেই পারে চা-টা যথেষ্ট অখাদ্য হবে। কিন্তু এতটা ভেতরে বসে শুধু চা খাওয়া ঠিক কিনা বুঝতে পারে না। ছেলেটি এলে বলে, এক কাপ চা-ই দিন, পরে কিছু নিলে বলব।
কিন্তু ছেলেটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে একটা চায়ের ডিশে গাদাগাদি মিষ্টি নিয়ে। সুহাস বুঝতেই পারত না মিষ্টিটা তারই জন্যে, যদি-না তার একেবারে মুখের সামনে এনে এই ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকত। আর সুহাস কিছু বলতে পারার আগেই ধুতি-গেঞ্জিপরা লোকটি সামনে এসে দাঁড়ায়। সুহাস বুঝে ফেলে, দোকানের মালিক। এতক্ষণ রসে থাকার জন্য ধুতির গিট তলপেটের অনেক নীচে নেমে গেছে, গেঞ্জিটা পেটের ওপর দিয়ে অতটা ঢাকতে পারছে না। খুব ফাইন ধুতি আর ফাইন গেঞ্জির মাঝখানে রোমশ একটা মোটা লাইন।
ছেলেটির হাত থেকে ডিশটা নিয়ে বলে, জল নিয়ে আয়, তারপর দু হাতে সুহাসের সামনে ধরে বলে, স্যার, নিন স্যার, আমার দোকানের মিষ্টি স্যার কলকাতায় যায়, চাবাগানের সাহেবরা বাগডোগরায় প্লেন ধরতে যাওয়ার সময় এখান থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যান স্যার। বিকানীর সুইটস স্যার।
সুহাস তখন পারলে উঠে পালায়। কিন্তু লোকটার কথাতে, তার দোকানের আর মিষ্টির তারিফে, সে একটু স্বস্তি পায়–অন্তত এইটুকু বাচোয়া। কিন্তু তার সামনে লোকটি দুই হাতে এইটুকু ডিশে এমন পাজা করা মিষ্টি ধরে আছে–দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি এপাশে-ওপাশে তাকায়। বুঝতে পারে, সামনের বেঞ্চিতে যারা খাচ্ছে তারা ব্যাপারটা দেখছে। কিন্তু দোকান-ভর্তি মদেশিয়া আর রাজবংশী মজুর কৃষকরা এদিকে তাকাচ্ছেও না।
সুহাস তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা চুকিয়ে দিতে চেয়ে বলল, আমি মিষ্টি খেতে পারি না। আপনি নিজে এনেছেন। একটা মিষ্টি দিন।
আচ্ছা স্যার, আমি জিদ করব না। কিন্তু আপনাকে টেস্ট ত করতেই হবে। রোজ একটা করে টেস্ট করলেই আমার সব মিষ্টি টেস্ট করা হয়ে যাবে। এই ডিশ লাও, লোকটির গলা খাদে আর চড়ায় খেলে গেল।
ডিশ মানেই অন্তত গোটা দুয়েক। সুহাস তাড়াতাড়ি হাত পেতে লোকটিকে বিপন্ন করে–হাতে দিন, একটা।
এ স্যার কি হয়, আপনাকে হাতে দিব?
আমার ত হাতে খেতেই ভাল লাগবে–সুহাস মনে-মনে চটে। হঠাৎ মনে হয় দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
বোধহয় তার মুখ দেখে দোকানদার কিছু আঁচ করে। সে সবচেয়ে তলা থেকে লম্বা, গোল সাইজের সবচেয়ে বড় মিষ্টিটা বের করে। সুহাস বলে, এইটি দিন, ওপরের সন্দেশটি দেখায়।
এ কী স্যার, এটুকু কী হবে স্যার, এ ত গালে দিতেই গলে যাবে।
ঠিক আছে, ঐটিই দিন।
ইতিমধ্যে বাচ্চা ছেলেটি ডিশ নিয়ে এসে বেঞ্চির ওপর রাখে। তাতে সন্দেশটি তুলে দিয়ে আর-একটি মিষ্টিতে চামচ লাগাতেই সুহাস ডিশটি সরিয়ে নিয়ে বলে, উ–।
দোকানদার হে হে করে হেসে উঠল, স্যার, চা পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে চলে যায়।
সামনের বেঞ্চিতে যারা বসে খাচ্ছিল তাদের ভেতর একজন উঠে সুহাসকে নমস্কার করে বেরিয়ে যায়। সুহাস প্রতিনমস্কারের সময় পায় না। আর, তারপরই হাট কমিটির সেই বয়স্ক ভদ্রলোক এসে তার সামনের বেঞ্চিটাতে বসেন, হাটটা দেখলেন?
এখন ত সন্ধ্যা। বোধ হয় বিকেলে জমে বেশি।
না, সে ত এখনো জমাই আছে। এ ত ডুয়ার্সের প্রায় ধরেন কেন বড় হাট। ধূপগুড়ির হাটঠে অনেক ঘট! ধূপগুড়ির হাট ত পাইকারি হাট।
সুহাসের মনে পড়ে যায়, সে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, এখানে কি শুকনো লঙ্কা তৈরি হয় নাকি? হাটে শুকনো লঙ্কার পাহাড় দেখলাম।
ছেলেটি এসে চা-টা রাখে।
না, না, এখানে শুকনা লঙ্কা হয় কোটে? এইঠে ত শুকনা লঙ্কা না হয়। ধরেন, এই ক্রান্তির হাটতও বছর খানিক আগতও শুকনা লঙ্কা না আছিল। তখন নারায়ণপ্রসাদের গোডাউন ছিল শিলিগুড়ি।
নারায়ণপ্রসাদ কে?
এই ধরেন কেনে এই তামান এলাকার, আসামের, শুকনা লঙ্কার ডিলার। উমরার শুকনা লঙ্কার মালগাড়ি ত এখন মাল স্টেশনে আসে।
ত সে এখানে কী করে?
নারায়ণপ্রসাদ বছর তিন আগে এইখানে একখান চাবাগান কিনি নিসে। ত বাগান মাস ছয় পর হয়্যা গেইল বন্ধ। নারায়ণপ্রসাদ ওর এই বাগানের গোডাউনটাক বানাইল শুকনা লঙ্কার গোডাউন। ব্যস, সেই থাকি আসাম আর তামান-তামান জায়গায় সব পাইকারি বেচাকেনা হবার ধরিছে এই ক্রান্তি হাটত। স্যালায় ত ক্রান্তি হাটার এ্যানং নামডাক।