.
০১০.
হাটের আড়ালে হাট
হাটের পুব দিক থেকে উত্তর ঘিরে যে রাস্তাটা বেঁকে গেছে, সেই সমকোণেই ত এই হাটটা বসেছে। হাটের পাশে সারি সারি দোকান হাটটাকে রাস্তা থেকে আড়াল করেছে। বেশির ভাগ দোকানের মুখ রাস্তার দিকে। দু-একটা দোকানের পরই একটা করে ফাঁক-হাট থেকে বাইরে বেরবার। এ রকম ফাঁক-ফোকর অনেক।
তেমনি একটা ফাঁকের পাশে দু সারি দোকানের মাঝখানে পাটহাটিরও উত্তরে এক লম্বা-জমিতে হাটের আড়ালে হাট। খুব কাছাকাছি লাইন দিয়ে কুপি জ্বলছে। একদিকে সেই কুপির আলো বাইরে বেরতে পারছে না, নোয়ানো মানুষগুলোর মুখ চোখকেই শুধু আলোকিত রাখে। আর-একদিকের শিখাগুলোতে কোনো আড়াল নেই, যেন দমকা বাতাসে নিবে যেতে পারে। সাট্টা, জুয়া, ডুগডুগি খেলা চলছে। জায়গাটা লম্বাটে। জুয়ার টেবিল মাটির ওপর বা টুলের ওপর বসেছে লাইন দিয়ে–যেন বসার ভেতর একটা পরিকল্পনা আছে। কোনো কথা বা আওয়াজ শোনা যায় না। কেউ-কেউ দাঁড়িয়ে এ টেবিল থেকে অন্য টেবিলে উঁকিঝুঁকি মারছে। বেশির ভাগই নিচু হয়ে খেলছে। জায়গাটা যেন অন্ধের হাত। কেউ কিছু দেখছে না। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেআইনি হাট বসে গেছে। আসল হাট উঠে যাবে, এই হাট যতক্ষণ ইচ্ছে চলবে। কিন্তু বেআইনি বলেই এক ধরনের দ্রুততা আসে। সবাই যেন একই দ্রুততায় নিজের খেলাটুকু সারতে চাইছে।
আর-এক পাশে সারি সারি অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি আর গ্লাশ নিয়ে মেয়েরা। ডেকচিগুলোর ওপরে গামছার ঢাকনা। প্রত্যেক ডেকচি ঘিরেই ভিড়। হাড়িয়া বা পচাই। কোনো মাতালের স্বলিত চিৎকার নই। খুব চাপা স্বরে, প্রায় ফিসফিসের মত, স্বরের জড়তা, কথাটা ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার মত শোনায়।
মাটি থেকে উঠছে কেউ। এতক্ষণ মাটিতে গড়াচ্ছিল। হামাগুড়ি দিয়ে, উবু হয়ে বসে, দুই হাঁটুতে দুই হাতের ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু আবার সোজা উঠতে থাকে, মাথাটা একটু দোলে, তারপর খাড়া দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলে, দেখলে, দেখ। দেখ দেখ, ভাইমন অউর হিনমন, দেখো, হাম খাড়া উঠলেক হো—আ-আ-ডা। এই খাড়া হয়ে উঠতে ও খাড়া ভাবটা রাখতে, তাকে কিছুটা মেহনত করতে হয়। তার পা যাতে না টলে তার মাথা যাতে না টলে, সেটা সামলাতে তাকে শুধু কোমরটা টলাতে হয়, কোমর থেকে গলা পর্যন্ত অংশটাও পাক খায়। ফলে সেই অন্ধকারে তার এই একান্ত একাকী প্রয়াস চলতে থাকে–সে শক্ত ও সোজা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, মাথাটা শক্ত ও সোজা, মাফখানের পেট, বুক মাঝে মাঝেই যেন ভেঙে পড়তে চায় কিন্তু কোমরটা দুলিয়ে সেটা সামলাতে হয়। সেই সামলানোর সময় কোনো পা হয়ত হাঁটু দুমড়ে পড়তে চায় কিন্তু তখন পটের দুলুনি উরুতে এনে উরুতেও একটা দোলানি দিয়ে সে ভাঙনটা রোখে। আর এর সঙ্গেই সেই স্থির মাথার স্খলিত উচ্চারণে সে চ্যালেঞ্জ জানায়, কুন কহথে মায় মাতৃগেলাক? কভি নেহি। হাম কভি মাতোয়ালা হনে নাহি শেকথে। এই দেখ। পাক্কা দে। হাম এই দোনো পায় পর খাড়া হয়। এই দেখ। পাক্কা দে। হামারা ই মাথাঠে ভি খাড়া হায়! তব? তব ভি হাম মাতোয়াল? কভি নেহি? এই দেখ, হাম পারিড করেগা। রে-ডি, ওয়ান টু থ্রি, লেফট রাইট, লোকটি তার পা দুটো একবারের বেশি তুলতে পারে না। তাতেই তার সমস্ত শরীরটা হুমড়ি খেয়ে যায়। লোকটা মাটির ওপর শুয়ে পড়ে।
আবার কিছুক্ষণ পর লোকটি হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে কিন্তু বসে না। হামাগুড়ি দিয়েই ঐ হাড়িয়ার সারির দিকে এগয়। তারপর এক জায়গায় গিয়ে থামে। হামাগুড়ি থেকে উবু হয়ে বসে। আবার দাঁড়াবার জন্য দুই হাঁটুর ওপর দুই হাতের ভর দেয় কিন্তু উঠতে পারে না বা ওঠার চেষ্টাও করে না। সেখান থেকে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে বলে, দেখ, হাম পারেড ভি করলেক, আভি হামকো অউর এক গ্লাশ দে। হাম তো মাতোয়াল নাহি হোলাক, হে ডায়ানা, হাম জরুর অউর এক গ্লাশ পিগা, হে ডায়ানা, হামকো জরুর–
যে-মেয়েটি গ্লাশে-গ্লাশে হাঁড়িয়া দিচ্ছিল তার কাছে গিয়ে লোকটি দাঁড়ায়। যারা খাচ্ছিল তারা কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। মেয়েটির পাশে গিয়ে বসতে চেষ্টা করে। কিন্তু পা দুটো ভাজ করতেই টলে যায়। তারপর একবার টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পড়ে যায়। মাটির ওপর সোজা হয়ে বসে সে আবার সেই মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, হে ডায়ানা, হাম জরুর পিয়েগা, পয়সা লে, দারু দে। সেই মেয়েটি তার দিকে মুখ না ফিরিয়ে ডান হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিতেই লোকটি একেবারে গড়িয়ে যায়। আর ওঠে না।
বাতাসের মত ফিসফিস ফিসফিস স্বরে সহসা রটে যেতে থাকে জাপানি টেরিলিন, ষাট টাকা প্যান্ট পিস, সিকো ঘড়ি, বাঁ-হাতের পাতার ওপর মেলে ধরা কোনো ঘড়ির রেডিয়ামের বিদেশী দ্যুতিতে অন্ধকারে আদিবাসী চিবুকের ডৌল। লোকটা মুঠো বন্ধ করে ফেলে। আলো নিভে যায়। চিবুকের ডৌল অন্ধকারে মিশে যায়। বাতাস পাক খায় জাপানি হংকং, মেড ইন ইউ. এস. এ। সাট্টা আর জুয়োর ভিড়টা হুমড়ি খেয়ে খেলছে। আর চাকা থামলে, বা ডুগডুগি ওঠালে, বা, লুডোর গুটির মতো গুটি ফেললে একবার সমবেত হি-ধ্বনি উঠেই আবার চাপা হিংস্র নীরবতা।
জুয়োর বোর্ডের কিছু দেখা যায় না। কুপির শিখা মানুষজনের মুখের ওপর লকলক করছিল, দপদপ করছিল, পিছলে যাচ্ছিল। হাটের দূরদৃশ্যের মত নয়–অতি নিকট দৃশ্য। এত নিকট যে হাত-পাও দেখা যায় না, শুধু মুখ, বা সূর রেখা বা কপালের চ্যাপ্টা বা কালো কুচকুচে নাকের একটি পাশ। সাট্টা বোর্ডের কুপির আলোতে চেনা যায় না বোর্ডের মালিকের মুখটা-নেপালি, রাজবংশী, মেচ; কোচ, রাভা যে কোনো কিছু হতে পারে, পেছন থেকে দেখলে মাথার খুলিতে সঁওতালের লম্বাটে ধাচও যেন দেখা যায়।
১.২ হাটের সামাজিকতা
০১১.