পাইকার-হাটির পুব সীমা ধরে, হাটের দিকে মুখ করে বসা পাটহাটি! একটা সারিই এদিকে মুখ করে। তার পেছনের অংশটা মাঠেই ছড়িয়ে। সেখানে গরুর গাড়ির সারি, ওপরে পাটের বোঝা। গাড়ি ধরেই বিক্রি। এখনো গাড়িই আছে। আর গরুর গাড়ির আনাচকানাচে সামনে-পিছনে মানুষজনের আসাযাওয়া। গরুর গাড়ির চাকার ফাঁক দিয়েও দেখা যায়-ওদিককার কিছু মানুষজনের বসে থাকা বা চলাফেরা। পাটহাটির গরুর গাড়িগুলোতে লণ্ঠনই বেশি। আবার রাস্তা ধরে যেতে হবে। মাঝে-মাঝে শুধু টর্চ ঝলসায়।
পাইকার-হাটির দিকে মুখ করে বসা, পাটহাটির প্রথম লাইনটার শেষে দক্ষিণ সীমায়, মাটির ওপরই ছড়িয়ে রাখা হাল আর হালের আল। হালই বেশিফরেস্টের বিনি পয়সার কাঠে বানানো–বেশ বড়, শক্ত, হাল। ছোট রাস্তার ওপর ছড়ানো চা বাগানের চোরাই কলমকাটা ছুরি, দা কোদালি, ফাড়য়া। তার পাশে কামারের তৈরি দাকুড়োল, হাতুড়ি বড় সাইজের। কিন্তু সংখ্যায় বেশি নয়। আজকাল টাটা কোম্পানির কোদাল আর কুড়ল পাওয়া যায় লোহার দোকানে, তার ভারও বেশি, ধারও বেশি, দামও বেশি। তারও পাশে প্রায় অন্ধকারে কিছু চেয়ার, টেবিল, ছোট আলমারি–জাল দেয়া, এমন-কি একটা আয়না-লাগানো ড্রেসিং টেবিলও–বেশ চকচকে পালিশে মোমের আলো পিছলে যায়। আপাতত মনে হয়, হাটটা বুঝি এইখানেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তারও পর, অন্ধকার মাঠ থেকে দুর্গন্ধ আসে। একটু নজরে লোকজনের আসা যাওয়াও বোঝা যায়। সারের এফ-সি-আই-এর ইউরিয়া আর মিশ্রসারের চোরাই বাজার। বসেই সন্ধ্যার পর। একটুখানি সময়ের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।
সারের হাটটার কাছে ত পৌঁছনো যায় না। গন্ধে তার আভাস পাওয়া যায়। মনে হয় হাটটা যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু সেই অন্ধকারের দিকে, সেই গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে তাকিয়ে থাকলে যেন মনে হতে থাকে দূরে-দূরে অন্ধকারে, মাঠে-মাঠে, আরো দূরে-দূরে হাটটা ছড়িয়ে-ছড়িয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার সেই মাঠের ভেতর থেকে আওয়াজ উঠে আসে চাপা প্রতিধ্বনির মত, কিন্তু ধারাবাহিক। যেন বাশের পঁজার ওপর গাড়ি-গাড়ি বাশ ফেলার আওয়াজ। সেই চাপা আওয়াজ একবার শোনা গেলে কানে আসতেই থাকে। থামে না। হতে পারে, ট্রাকের পর ট্রাক বাঁশ লোড হচ্ছে–টিটাগড়ের কাগজ কারখানার জন্যে। হয়ত ফরেস্টের সাপ্লাই। কিন্তু বেশির ভাগই কনট্রাকটারের। সে ফরেস্ট থেকেও কেনে, চাষির কাছ থেকেও কেনে। নইলে গ্রামের বন্দরের হাটে কখনো বাশহাটি বসত না। আবার হতেও পারে এটা বাশের আওয়াজই নয়। এমন ধারাবাহিক আওয়াজ ত অন্ধকারের ভেতর থেকে নানা কারণেই উঠতে পারে। দিনেও হয়ত ওঠে। কিন্তু অন্ধকারেই হয়ত বেশি শোনা যায়। তিস্তা কোন দিকে? কতদূর? তিস্তার বন্যায় ফরেস্টের কোনো শাল-সেগুন ভেঙে পড়েছে। এখন অন্ধকারে রাতারাতি তা টুকরো-টুকরো হয়ে বেরিয়ে আসছে। হতে পারে সেই কুড়োল কাটার শব্দ। বা, এখন সন্ধ্যায়, সেই দূরের ন্যাশন্যাল হাইওয়ে দিয়ে ট্রাকবাস যাওয়ার আওয়াজ মাটি কাঁপিয়ে আসে। বা পাহাড়ের ওপরের কোনো বন্যা ন্যাওড়া নদী দিয়ে এখুনি বয়ে যাচ্ছে–দুই পাড়ে ধাক্কা দিয়ে আরে বেগে ও আরো বেগে। কোথাও হুড়মুড় করে পাথর পড়ছে? নাকি চা বাগানের জেনারেটারের আওয়াজ ফরেস্টে নদীতে প্রতিধ্বনিত হয়ে-হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে? কুপি আর মোমবাতি, কারবাইড আর হ্যাজাকের আলোতে হাটভরা মানুষের আকার অনেক বড় হয়ে গেছে। অন্ধকারটাই প্রধান মাঝে-মাঝে আলোর ছোঁয়া, আবার কোনো-কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে দু-একবার দিগন্ত বা কোনে অন্যমনস্কতায় আকাশ চোখে পড়লে ব্যাপ্ত অন্ধকারটাই দেখা যায়। আলোর নানা বৃত্তেও শুধু উজ্জ্বলতা নয়। কোনো মদেশিয়া রমণীর পিঠে কাপড় দিয়ে বাধা বাচ্চার মাথা দোল খায়, ওপরেই জেগে থাকে লাল ও কিছু অস্পষ্ট রঙের বুনো ফুলের ঝাড়, কালো চুলে। কালো মুখ অন্ধকারের সঙ্গে কোন অনির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে গিয়ে মেশে। নাইলনের উজ্জ্বলতা পিছলে যায় কোনো তাগড়া আদিবাসী বুক থেকে ধনুকের একটা মাথা দেখা যায়। রাজবংশী রমণীর ফোতার ওপরে উঠে আসে নগ্ন হাত, গলাকাঁধ অন্ধকারে ঝিলিক দেয় কুচকুচে আদিবাসী রমণীর ঝকঝকে দাঁতের সারি। কোথাও নিষ্ঠুরতা ঘটে যেতে পারে। বটগাছের গুঁড়ির মত ভূয়োদর্শী মোঙ্গলয়েড মুখ চামড়ার অসংখ্য কুঞ্চনে নদীর চরের মত জেগে থাকে। কোথাও জমি চষা হয়ে গেছে। মেদহীন তীব্র পাহাড়ি চিবুকে পার্শমুখের শান। টিলার মাথা থেকে সমতল দেখা যায়। এ হাটের বেচাকেনা শেষে এখন যেন ভিড়েরই মুখ–বহু শত বর্ষের আদিবাসী ঘরানার মুখোশে অলঙ্কৃত সে-মুখময় শুধু বিস্ময় বা বিস্ময়ের অবসান। রেখা, রং আর অঙ্গসংস্থানে কোনো নতুনত্ব নেই, একটি মুখোশ থেকে আর-একটি মুখোশ আলাদা করা যায় না, অথচ প্রতিটি মুখোশই আলাদা হয়ে যায় অনিবার্য। এই দীর্ঘ-দীর্ঘ ছায়াসন্নিপাতে সেই মুখোশের ক্ষণিকতা অথচ তার বড় বেশি নির্দিষ্টতায় বিদ্যুচ্চমকিত অরণ্যের আভাস যেন খেলে-খেলে যায়। বা, কখনো, বিদ্যুচ্চমকের জন্য অরণ্যের অন্ধকার প্রতীক্ষা। সেই প্রতীক্ষাতেই নাচের গানে পাহাড়ের প্রতিধ্বনির ক্ষীণতা আসে। একাকী ঢোলে বোল ওঠে। কোন বিস্মৃত নিঝর বয়ে যায়। আর এই ভিড়, আর সওদা, আর বেচাকেনা, আর ভিড়, আর সওদার ভেতরে মিশে গিয়েও মিশতে পারে না, ভিড়ের হয়েও ভিড় থেকে যেতে পারে না, আরো একবার মেলায় এসেও যেন হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে যাওয়ার মত বিষণ্ণ, আত্মবিস্মৃত, বিচ্ছিন্ন মুখ, মুখ, মুখের সারি।