এই প্রায় সব হাটের প্ল্যান যেন একরকম। সদর রাস্তার দুপাশ দিয়ে সারি বাধা ঘর, দোকান। হাটটা সব সময় সেই সব ঘরের পেছনে পড়ে যায়। দুই দোকানের মাঝখানের ফাঁকগুলো দিয়ে হাটের ভেতরে ঢুকতে হয়। যেন, একসঙ্গে পাশাপাশি দুই মানুষ ঢোকা যায় না এমন সব ফাঁক দিয়ে হাজারে হাজারে মানুষ ভেতরে ঢুকে বসে আছে। গরুর গাড়িগুলোর ভেতরে যাওয়ার একটা রাস্তা থাকে, সেটা হয়ে দাঁড়ায় হাটের পেছন। হাটের জন্যেই হয়ে যে-দোকানগুলো হাটটাকে আগলিয়ে সদর রাস্তার মুখোমুখি থাকে, সেই দোকানগুলোই যেন হাটটাকে দাবিয়ে প্রধান থাকতে চায়। মিষ্টির দোকানগুলোতে বাইরে তক্তপোশের ওপর শাদা চাদর পেতে জিলিপির পাহাড় ওঠে। কাপড়-গামছার দোকানে ও বারান্দায় কাপড়-গামছা ঝোলে। এমন কি, সাইকেলের দোকানে রাখা সাইকেলও দোকান উপছে রাস্তায় এসে পড়ে। আর, এই সবের ঘনিষ্ঠ আড়াল থেকে মানুষের সমবেত কণ্ঠ প্রবল হয়ে ওঠে। সেই কণ্ঠের কোনো আওয়াজের কোনো অর্থ করা যায় না, কোনো একটি ধ্বনিকে আলাদা করা যায় না, সমস্তটাই হয়ে ওঠে ধ্বনির প্রবাহ, প্রায় নদীস্রোতের মত। নদীস্রোতের মতই নেপথ্যের সেই প্রবল বর্ততান তার উচ্চতম কোলাহলের জোরেই একটা অস্তিত্ব হয়ে ওঠে ও আঘাতে-আঘাতে হাটের বাইরের এই দোকানের সারিকেও হাটের অন্তর্গত করে ফেলে। দোকানগুলোও হাটের ভেতরে ঢুকে যায়।
.
০০৯.
এই হাটটা কেমন
সন্ধ্যার পর হাটের একটা চেহারা এসে যায়। সারাদিন ধরে হাটটা যত পারে খুলেছে, সধ্যা হওয়ার পর সেটা যত পারে ছোট-ছোট টুকরোয় ভাগ হয়ে যেতে থাকে। আর এই টুকরোগুলো তৈরি হয় উজ্জ্বল আলোককেন্দ্রগুলোকে ঘিরে।
এখন, এই হাটের পাইকারি বাজারের দিকটা যেন খালি। গো-হাটার দিক ত প্রায় অন্ধকার। মাটির হাঁড়িকলসী বিক্রির বিরাট এলাকা হাটের পশ্চিম সীমা জুড়ে, তাতে যে শুধু খদ্দের নেই, তা-ই নয়, দোকানদাররাও কেউ-কেউ উঠে পড়েছে। তরি-তরকারির বাজারে ভিড়টা আছে–শেষ দিকের ঘরুয়া হাটের মানুষের ভিড়, শস্তায় নানারকম জিনিশ এখন পাওয়া যায়। জামাকাপড়ের দোকানগুলোতেও ভিড় লেগে আছে, বিশেষ করে নাইলনের গেঞ্জির দোকানে।
আলো কোথায় বেশি আর কোথায় কম এই নিয়ে যেন হাটটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। একেবারে উত্তরে, এক কোণে, একটা চালাঘরে চায়ের দোকানের মুখ হাটের দিকে। সেখানে হ্যাজাক জ্বলছে। চালাঘরটা এই হাটের যেন শুরু। কিন্তু তার বাইরেটা যত পরিষ্কার দেখা যায়, ভেতরটা তত দেখা যায় না। সামনে দাঁড়ালেও মানুষকে মনে হচ্ছে ভেতরের অন্ধকার থেকে বাইরের আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের আর জামার এক-একটা অংশ একটু উজ্জ্বল বাকিটা অন্ধকারে মিশে আছে। সামনে কতকগুলো বেঞ্চ। তাতেও অনেকে বসে। তাদের ছায়াও সেই চালাঘরের ভেতরের দিকে পড়ায়, ভেতরটা আরো অন্ধকার।
তার সামনে এমনি কিছুটা অন্ধকারের বিস্তার, যেন মনে হয় কিছুটা জলের ওপারে ঐ চালাঘর। সেই কিছুটা অন্ধকার পেরিয়ে দুটো লম্বা সারির আলোর গলি। দুটো গলি না তিনটে গলি বোঝা যায় না। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক দোকানেই হ্যাজাক থাকায় মনে হয় ওখানে একটা বেশ বড় বেচকেনা চলছে। জামাকাপড়ের দোকান। সবগুলো আলোই হ্যাজাকের নয়, মাঝে-মাঝে কার্বাইডের আলোও আছে। হ্যাজাকের লালচে আলোর পুঞ্জগুলির মধ্যে কার্বাইডের আলোর নীল শিখাগুলি ও সেই শিখাগুলির বিচ্ছুরিত আলোর ঠাণ্ডা বৃত্ত রঙের কেমন একটা নকশা তৈরি করে কমলায়-নীলে-ফিরোজার।
সেই আলোর নানা রঙের মিশেলের ওপর, আবার কুপি জ্বালানো অন্ধকারের চাকের পর, ঐ কাপড়হাটির সমকোণে লম্বা হাঁড়িহাটি। সারি-সারি উল্টনো হাঁড়ির ওপর কুপি বসানেলাইন করে, যেমন জলের ভেতর চরের নিশানা থাকে, একটু পরপর। কুপির আলোর বৃত্তের মধ্যে পোড়ামাটির লালচে। তেমনি পোড়ামাটির লালচে বৃত্ত, পর পর, পর পর, অনেক দূর। লম্বা সারির নির্জনতায় কুপির শিখা কাপে, মাটির হাঁড়িতে লালচে বৃত্ত দোলে, গোল-গোল মাপ-মত ছায়ারা হাঁড়ির বর্তুলে ছলকে-ছলকে যায়–যেন অন্ধকার, জলের মত তরল। ফলে, মনে হয়–এই দৃশ্যটা সাজানো। বা, এ যেন ঠিক হাটের ভেতরের দৃশ্য নয়।
হাঁড়িহাটির পরেই গো-হাটা, অন্ধকার, এক-একটা টর্চের আলো আচমকা ঝলসে যায়। এক-একটা হা-ম্বা ডাক অন্ধকার থেকে উঠে অন্ধকারেই আবার মেশে। ডাকের শেষটুকু একটা রেশ হয়ে যায় বলেই মিশে যেতে পারে। গো-হাটার কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু হঠাৎ এই হাম্বা-ডাকে কেমন যেন, মনে হয় ওখানে অন্ধকারে কাদায় পা ডুবিয়ে নীরবে যেন অন্ধ হয়ে আছে আরো পশুপাখি, মোষ, মুরগি, হাঁস, পায়রা, পাঠা। তারা এখন অন্ধকারে ক্রমেই অন্ধ ও নীরব হতে থাকবে।
গো-হাটিকে ডাইনে রেখে বয়ে বেঁকলে, আবার একটা সমকোণে, একটু ডাঙামত জায়গায় ক্রমেই দক্ষিণ থেকে দক্ষিণে ছড়িয়ে গেছে এই হাটের সব চেয়ে বড় বাজার–পাইকার-হাটি। এখন সেই বিস্তারটা বোঝা যায়, বোধ হয় জায়গাটা ডাঙা বলেই, ক্রমেই উত্তর থেকে দক্ষিণে ডাঙা বলেই। এখন সেই ডাঙাটা বোঝা যায়, বোধ হয় জায়গাটা প্রায় একেবারে ফাঁকা বলেই, ক্রমেই বেশি কাঁকা আর যত দক্ষিণে তাকানো যায়, তত বেশি ফাঁকা। এই ডাঙাটার মধ্যে বা শেষে কোথাও আর বেশি আলোর কোনো দোকানপাট বা বাজার নেই। তাই এই ডাঙাটায় ছড়ানো কুপি, মোমবাতি আর লণ্ঠনের আলোয় যেন মনে হয় নদীর ভেতরে ছড়ানো-ছিটনো আলোজ্বালানো নৌকোর নদী। সেই একই রকম উজ্জ্বলতার আলো অতটা জায়গা জুড়ে ডাঙা হয়ে ছড়িয়ে আছে। তকতক করে বারবার ঝাড় দেয়া মাটি। তবু বর্ষা বলে কালচে। আর তাতে ছোট-ছোট ঢিবি, বেশির ভাগই শুকনো লঙ্কার, অনেকগুলো আলুর, মনে হতে পারে শুকনো লঙ্কা আর আলুই এদিককার প্রধান জিনিশ। পাইকারি হাটটায় আলু আর শুকনো লঙ্কা, আলু আর শুকনো লঙ্কা আর মাঝে-মাঝে পেঁয়াজের পাজাই ফাঁকায় ফাঁকায় ছড়িয়ে। এক-একটা পঁজার জন্য অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দেয়া। বেচাকেনায় অনেকখানি জায়গা দরকার। মাঝে-মাঝে মোটা বাশের চারটে খুটিতে কাঠের বিরাট-বিরাট পঁড়িপাল্লা ঝুলছে। সেই বিরাট সাইজের পাল্লাগুলোর একটা দিকে ভার বসানো। আর-একটা দিক বাতাসে দোলে। মোমবাতি আর কুপির শিখার আলোতে ঐ বিরাট কাঠের পাল্লা আর লম্বা নাইলনের দড়ি অতিকায় ছায়ায়-হায়ায় পাক খায়।