- বইয়ের নামঃ তিস্তাপারের বৃত্তান্ত
- লেখকের নামঃ দেবেশ রায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.১ আদিপর্ব – গয়ানাথের জোতজমি
০০১.
হাটের পথে
একই হাটে একসঙ্গে দুটো সাইনবোর্ড যাচ্ছে–এ বড় একটা দেখা যায় না।
একটা বেশ লম্বা-চওড়া, বড়, নতুন। হলুদের ওপর কাল, সরকারি সাইনবোর্ড যেমন হয়, শিলমোহর আঁকা, কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র। আরো কী সব। টানতে লোকটির বেশ কষ্ট, একবার ঝুলিয়ে নেয়–কিন্তু তাতে রাস্তায় ঠুকে যায়। বগলেও নেয় দু-একবার–তাতে কাত হয়ে বেড় পাওয়া যায় না। অবশেষে মাথায়। সেটাই সবচেয়ে সুবিধের। এক হাতে মাথার ওপর সাইনবোর্ডটা ধরা, আর-এক হাতে নাইলনের জুতোজাড়াটা ঝোলানো«পেছনের ঝোরা পেরতে খুলতে হয়েছিল, সামনে আছে পায়ে ও ফেরিতে পার-হওয়ার আরো নদী, বার তিন-চার। নাইলনের, পান্টটাও হাটুর তলা পর্যন্ত গোটানো, বেশ ভাজ করে করে, যেন নদীগুলোর জলের মাপের একটা আন্দাজ আছে।
আর একটা সাইনবোর্ড, ছোট। কালর ওপর শাদা–কিন্তু মনে হয় বহুকালের। শিলমোহর আঁকা। বেশ বড় বড় হরফে, হলকা ক্যাম্প। থলির সঙ্গে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে বিড়ি খেতে-খেতেই যাওয়া যাচ্ছে। বিড়ি না খেলে আর-এক হাতে করবেটা কী? ধুতিটা হাঁটুরও ওপরে-নদী-নালা-কাদাবালি পেরিয়ে যাওয়ার মত। পায়ের নতুন নীল ব্যান্ডের হাওয়াই স্যান্ডেলটার সোল আছে শুধু আঙুলের সঙ্গে খানিকটা। এতটা ক্ষইয়ে দিতে বেশ কয়েক বার নতুন ব্যান্ড পরাতে হয়েছে। পায়ের সঙ্গে এমন ভাবে মিশে গেছে যে, খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিতে গেলে খসে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে। পা থেকে খসাতে গেলে, পায়ের পাতাও যেন কিছুটা খসে আসবে। এটা খুললে চলার এই শব্দটা থেমে যাবে। তা হলে আর চলাই যাবে না।
‘কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র’ এখন তার জুতোজোড়াটাও সাইনবোর্ডটার ওপর ফেলে, দুই হাতে সাইনবোর্ডের দুটো দিক ধরে, বেশ দুলে-দুলে তাড়াতাড়িই ছুটছে–এতক্ষণে যেন সে তার চলার একটা গতি বের করতে পেরেছে। অত বড় সাইনবোর্ডের টিনে ডডং-উং ডডং-ডং আওয়াজ উঠছে। ওপরে জুতো জোড়াটাও লাফাচ্ছে। তার চলার ছন্দটা বেশ, টিন পেটাইয়ের আওয়াজে সব দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চার পাশ এত নির্জন, আওয়াজ বড় হলে কেমন ছড়িয়ে মিশে যায় বেশ।
চারপাশ নির্জন, শুধু এই রাস্তাটুকু দিয়ে লাইন বেঁধে লোক চলছে। আজ ক্রান্তির হাট। হাইওয়েতে বাস থেকে নেমে কেউ-কেউ রিক্সাও নেয়। তারপর রিক্সাঅলার সঙ্গেই ছোট-ছোট নালা ঠেলেঠুলে রিক্সা পার করে। ফেরিতে রিক্সাঅলাই নৌকোতে মাল তুলে দেয়। ওপারেও রিক্সা আছে আজকাল। বড়বড় মালপত্র যাদের, তাদের ত রিক্সা লাগেই। কাটাকাপড়, গেঞ্জি, লুঙি, শার্টপ্যান্টের দোকানিরা সাইকেলের সামনে ঝুলিয়ে, পেছনে বেঁধে, কাজ সেরে নেয়। কিন্তু আলুর বা এলুমিনিয়ামের বড় দোকানির ত রিক্সা না হলে খরচা বেশি পড়ে যায়–এক রিক্সার মাল কয়েক জনের মাথায়-মাথায় নিয়ে যেতে।
কিন্তু বেশির ভাগই হেঁটে চলে–মাথায় বা বাকে বোঝা ঝুলিয়ে। বাসে হাইওয়েতে নেমে, বাসের মাথা থেকে বোঝা নামিয়ে, রিক্সায়-রিক্সায় কয়েক মাইল দূরের হাটে যাওয়ার সুবিধে। কিন্তু যারা দক্ষিণে, চকমৌলানি থেকে বা উত্তরে সেই হায়হায়পাথার থেকে টাড়ি বাড়ি-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে, নদী-নালা, পেরিয়ে-পেরিয়ে, বাকে বা মাথায় বোঝা নিয়ে, বা গরু-ছাগল তাড়িয়ে-তাড়িয়ে রাস্তা ছোট করতে করতে আসে, তাদের আর এই পাকা রাস্তাটুকুতে রিক্সার দরকারটা কী। চিলতে রাস্তাটুকুতে যেন নদীর বেগ এসে যায়, একটু তলার দিকের পাহাড়ী নদীর বেগ, হঠাৎ ঘণ্টাখানেকের জন্য একটা বান বয়ে যাচ্ছে যেন। রিক্সাও বেশ ছুটে চলে, হটনও দেয়। পায়ের তলায় পাকা রাস্তা পেয়ে বোঝা-মাথায় বা বাককাঁধে মানুষের পায়েও বেগ এসে যায়। কেউ কারো দিকে তাকায়ও না, কথাও বলে না। তাড়াতাড়ি হাটার বা মাল বইবার ফলে মানুষজনের দ্রুত নিশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায়। চার পাশ এত নির্জন যে মানুষের শ্বাস নেয়া-ছাড়ার মত প্রায় নিঃশব্দ আওয়াজও মিশে যেতে পারে না, আলাদা হয়ে থাকে।
কিন্তু হাটে যাবার এখন শেষবেলা বলেই হোক বা এই রাস্তাটুকু পাকা বলেই হোক ভিড়টা ছুটতে থাকলেও কেমন জমাট থাকে। এতগুলো মানুষ একসঙ্গে একই দিকে যাচ্ছে–এতেই ত তাদের ভেতর বেশ একটা মিল পাওয়া যায়। তদুপরি, একজনের মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড আর আর-একজনের পিঠে বহু পুরনো এক ছোট সাইনবোর্ড যেন এই ভিড়টাকে আরো বেশি এক করে দিতে চায়–নিশান আর ফেস্টুনই যেমন মিছিল বানায়।
এখন, এই রাস্তার যে-ভিড়টুকু এদের দুই সাইনবোর্ডে বাধা পড়েছে, তার ভেতর দিয়ে হর্ন আর বেল বাজাতে বাজাতে রিক্সা আর সাইকেল একে বেঁকে বেরিয়ে যায় বটে কিন্তু তার পরেই ভিড়টুকু আবার জমাট। একজন একটিমাত্র ছোট খাশি নতুন দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে-টানতে নিয়ে যাচ্ছে। খাশিটার বোধ হয় আগেই কিছু অভিজ্ঞতা আছে বা ভয় পেয়েছে–এক পা-ও ফেলে না। লোকটিও বেশ নিশ্চিন্ত মনেই তাকে টানে। যেন জানে এভাবেই যথাসময়ে সে হাটে পৌঁছে যাবে। খাশিটা মাঝেমধ্যে রাস্তার ভেতর বসে যাচ্ছে। লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ছে। খাশিটাকে টানছেও না, সাধছেও না। খাশির, পেছনেই, এদিককার ছোট বড় সব হাটেরই সেই চা-ওয়ালা ছেলেটি, তার কাঠের বাক্স মাথায়, ওরই ভেতর উনুনকয়লা চাবানানোর অন্য সব সরঞ্জাম। খাশিটা বসে গেলেই সে খাশির ঠিক পেছনে ছোট করে লাথি মারছিল আর খাশিটা কয়েক পা দৌড়য়। ছেলেটি কখন হাত বাড়িয়ে একটা কঞ্চি টেনে নিয়েছে। এখন আর লাথি মারতে হয় না, লম্বা কঞ্চিটা দিয়ে যথাস্থানে খোঁচা দিলেই খাশিটা একটু ছোটে। তিনটে ছোট-ছোট মুরগি উল্টো করে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে লুঙিপরা একজন। মাঝখানে একটি বাচ্চা ছেলের মাথায় বেশ বড় সাইজের কুমড়ো। খুব ছোট টাইট হাফপ্যান্ট, পাতলা নেটের গেঞ্জি, মোজা-কেডস পরে একজন খালি হাতেই চলেছে। যতবার নদী-নালা পার হচ্ছে–ততবার জুতো-মোজা খুলছে আর পার হয়ে, পরছে। এদিকের ন্যাওড়া নদীর পুবের, বাগানের মজুররা ক্রান্তিহাটে খুব একটা যায় না। ক্রান্তিহাটের পশ্চিমে ত প্রায় শুধুই চা বাগান–হাটে তাদের একটা ভিড় হয়। এ হয়ত কোথাও গিয়েছিল, ফিরছে। বা হাটে কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা আছে। তেল কুচকুচে কোকড়ানো চুল। পাতলা নাইলনের গেঞ্জির ভেতর থেকে শরীরের রং চিকচিকচ্ছে। তার বেশ ক্যাপ্টেনি মেজাজ—চলনে। এক ঝাক হাঁস খাঁচায়। একটা বাকের এক দিকে একটা লাউ আর-একদিকে একটা বড় বস্তা ছোট করে বাধা। এক জনের মাথায় সের দশেক পাট। ছিটের হাফশার্ট, চেক লুঙি, রবারের পাম্পসু, কাঁধে গামছা, ঘাড়ে-গর্দানে পিঠে-কোমরে বেশ পেটানো মাংস। জোতদার ত বটেই, বেচাকেনার ব্যাপারিও বোধহয়। হয়ত,লোক দিয়ে গরুর গাড়ি ভর্তি করে বেচার মাল পাঠিয়ে দিয়েছে আগেই। নয়ত, কিছু বেচার নেই, কিনতে যাচ্ছে। বা, হয়ত হাট বলেই যাচ্ছে, দর-ভাও জানতে, তেমন কোনো কাজ নেই। ফোতা-পরনে একখানা বেটি-ঘোওয়ার মাথায় কলার ডোঙা ভাজ করে বানানো পাত্রে মাছ, সারাদিন ডোবায় ধরে এখন বেচতে যাচ্ছে। মাঝারি সাইজের এড়ে বাছুর অনেকক্ষণ ধরে আসছে–গলায় নতুন দড়ি। তার মানেই হাট। কিন্তু গোহাটা ত বসে সকাল থেকেই। যারা বেচে আর যারা কেনে তারা সারাদিন ধরেই প্রায় ঘুরে-ফিরে দেখে আর দাম করে আর নজর রাখে, কেউ যেন তার পছন্দটা কিনে না ফেলে। শেষ হাটে আসে চোরাই গরু। দামও পড়ে শস্তা। হাট পর্যন্ত যেতে হয় না অনেক সময়ই। রাস্তা থেকেই বেচা-বিক্রি হয়ে যায়। ক্রান্তির হাটটা অবিশ্যি, সেদিক থেকে চোরাই গরু বিক্রির খুব ভাল জায়গা হতে পারত। পুবে হাইওয়ে থেকে দশ মাইল ভেতরে, মাঝখানে। এক খেয়া, চার খাল। পশ্চিমে বিশাল আপলাদ ফরেস্ট আর চা বাগান আর পাহাড়ি চড়াই সেই বাগরাকোট কয়লাখনি আর শেভক ব্রিজ পর্যন্ত–কোনো বর্ডার পার করে ময়নাগুড়ি দিয়ে এনে এই রাস্তায় ঢুকিয়ে দিলেই হত। কিন্তু তার পর? এই চার খাল–এক খেয়া পার হবে কী করে? গরু বেচিতে রাখোয়াল ফক্কা। তাই বর্ডারের চোরাই মাল আর আসে না। এদিক-ওদিক থেকে দুটো-একটা চোরাই গরু ফরেস্টের ভেতর বেঁধেটেধে রেখে সময়-সুযোগ মত হাটের রাস্তায় এনে বেচে দেয়।