‘কেড়া কয় স্যার? এইডাই তো বরিশালের রেকর্ড হইয়া গেল–জিতি হারি যাই হোক। শিডিউল হইয়া জেনারেল সিট। এইডা স্যার বরিশালের বর্ণহিন্দুদের সাপোর্ট ছাড়া হইত না।‘
‘সে তো ভোটের পরের হিশাব মিলাইয়্যা দেইখতে হবি যোগেন। কিন্তু সেইডা তো কাস্ট হিন্দুগো ব্যাপার। কিন্তু হিন্দু বুইঝতে তুমি কী বুঝো?’
‘না, না, স্যার, আমি তো এইডা কই নাই যে বেবাক বামুন-কায়েত আমারে ভোট দিবে। আমি কইছি যে আমার যে সাধারণ-আসন থিক্যা খাড়া হওয়া গেল, তার পিছনে তো স্যার কিছু বর্ণহিন্দুর, আপনাগ নাগান, সাপোর্ট পাইছি বইল্যা।‘
‘তুমি তো তোমারে হিন্দু বইল্যাই ভাববা? বাড়ির কাজকর্মে তো তোমাগ বামুন লাগে?’
‘সে তো স্যার নমো-বামুন, পতিত। বামুন-কায়েতরা তো সেই পুরুত্ব দিয়্যা তুলসীপাতাও ছোঁয়ায় না।
‘আরে, সে তো হিন্দুগ সাইডের কথা, সে তো তোমাগ সাইডের কথা না?’
‘আমাগ সাইডের কি এইডা কম কথা স্যার? একডা নমকে হিন্দু-আসনে ছাইড়া দেয়া?’
‘তুমি কি বামুন-কায়েত হবার চাও?’
‘না স্যার, আমি নমশূদ্রই থাইকব্যার চাই। সে আকাক্ষি ছিল আমাগ বাপ-ঠাকুরদার। পৈতা পইর্যা বামুন হবার ধরছিল না?’
‘হয়। অ্যাহন তো হিন্দুগ সংখ্যা বাড়াইতে লাগব। বামুন-কায়েত আর কয়? তাগো দিয়া তো আর ফজলুল হকরে সামাল দিয়া যাবে না। মুসলিম লিগরেও ঠেকান যাবে না।’
‘সেইডা ঠিক কথা স্যার। যহন আমরা কইছিলাম, আমরাও বামুন, তহন বামুনরা কইল আরে চাড়াল তো চাড়ালই থাকব। আর, অহন মুসলমানরা যহন কবার ধইরছে আমরা আলাদা নেশন, তহন বামুনরা আইসা আমাগ ভজাইবার ধইরছে, আরে, চাড়ালও হিন্দু, তোগো কী সৌভাগ্য, হিন্দু বইল্যাই তো চাড়াল হইবার পারলি, মুসলমান তো আর চাড়াল হইবার পারে না। মোগল-বাদশাহেব পুরস্ত্রী মাত্রই অন্য রাজ্যের পাটরানী অপেক্ষাও বড়।‘
‘আরগুমেন্ট হিশাবে কিন্তু কথাডার একটা জোর আছে। কও, এর পালটা কী কবা? মুসলমান তো আর চড়াল হইবার পারে না। সুতরাং বাই ইমপ্লিকেশন, চাড়াল ইজ অন এ সুপরিয়র লেভেল টু এ মুসলমান। তার মানে এইডাও দাঁড়াইতে পারে যে, এ চাড়াল হ্যাঁজ এ স্ট্যাটাস। বলল, এই আরগুমেন্টটা তুমি অ্যাজ পার জুরিসপ্রুডেন্স সায়েন্স, তুমি কাটান দিব্যা কেমনে? মানে, উই আর ডিসকাসিং অ্যান অ্যাকাডেমিক পয়েন্ট। তোমার শার্প সেন্স অব কাউন্টার-আরগুমেন্ট আমরা তত লইখ্য করি। ইন ক্রিমিন্যাল সাইড দ্যাট ইজ অ্যান আসেট।‘
‘এইডা কি একডা কথা হইল স্যার? ওকালতি কি বামুন-কায়েতদের বিয়ার দুই পক্ষের পুরুতের ঝগড়া? আমি তো স্যার, আপনাগো দেইখ্যা-শুইন্যা শিখত্যাছি–ওকালতি মানে শুধুই ল পয়েন্ট, গলা কাঁপাইয়া চিল্লালেই কি আর চাঁদরায় হয়?’
‘সে বিষয়ে তোমার এড়ডু অসুবিধাই আছে, যোগেন।’
‘কী অসুবিধা স্যার?’
‘আরে, আমরা তো কেউ তোমার নাগাল পাবলিক স্পিকার না। কই, দেখছনি, কুনোদিন কুনো মিটিঙে মুখ খুলি?’
‘সে তো স্যার আরো বড় স্পিকিং পাওয়ার। একড়াও কথা কইল্যাম না কিন্তু যা বলার সব বলা হইয়া গেল।‘
‘আরে, কইতে পাইরলে তো কইব? কাল কোট, একখান চেয়ারের মাথা আর চোখের সামনে হাকিম না থাইকলে মুখে কথা ফোটে না। তুমি পারবা না যোগেন–তুমি য্যামন অরেটার, তোমার গলায় খুব ইনট্রিকেট ল-পয়েন্টেও, ঐ কইল্যা না, চাঁদরায়ের ঢক আইস্যা যাবে। তাতে ক্ষতি কী? এ তো একড়া অ্যাডিশন্যাল কোয়ালিফিকেশন। এই যে তোমার টাউন হলের মেগাস্থিনিস স্পিচে তুমি যে সেদিন কইল্যা যোগেন–ভেগাই হালদারের ইশকুলের কথা, ভর্তার বিলের কথা, মাহিলাড়ার মানে বাঘের গ্রামের খালের কথা-তহন সত্যি-সত্যি মনে আইল –হ তো, এইডাই তো আমাগ স্বদেশী হওয়া উচিত–এই ভেগাই হালদারের ইশকুল, বিলের বাঁধ, জলের খাল। এইডা তো তোমার স্পিকিং পাওয়ারের জন্যই সম্ভব হইল। আবিষ্কারের মত একখান। স্যান মশায় তোমার টাইটেলখান ঠিকই দিছেন–মেগাস্থিনিস!’
‘স্যার, সইত্যের তো কুনো শক্ত হয় না। ঐ কথা তো আমার অন্তরের কথা স্যার, ওর সঙ্গে ভোটাভুটির কুনো সম্বন্ধই নাই স্যার। আমি স্যার, আপনাগো মন জাগাইবার জন্য কই নাই। আমার নিজের মন জাগানোর জইন্যে কইছি।‘
‘আরে, তা না হইলে কি তোমার কথাগুলা মন দুইবার পাইরত, যোগেন? তোমার বিসমিল্লায় কুনো গলদ নাই।‘
‘আমি এইডা অনুভব করি স্যার, পৈতা পইর্যা আর পদবী পালটাইয়া নমশূদ্ররা কুনোদিন কাস্ট-হিন্দু হইবার পারব না। আরে, বামুন-কায়েত-বৈদ্যরা তো শুধু হায়ার কাস্ট না, হায়ার কালচার। সেই কালচার তুমি পাইব্যা ক্যামনে–এডুকেশন ছাড়া? এক এডুকেশনই তো তোমারে নমশূদ্র-পরিচয়ে প্রাইড দিবার পারে। স্যার, কয়ডা মানুষ জানে, খুলনার কুমুদ মল্লিক নমশূদ্রদের মইধ্যে প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ভীষ্মদেব দাস প্রথম উকিল, আর মল্লিকদের তিন ভাইয়ের কথা আর কী কইব। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির পালি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। আমাগ জাইতের তাতে কুনো চৈতন্য নাই। তাই উনাদেরও মনে থাকে না যে উনারা নমশূদ্র। এ নেশন উইদাউট এনি আইডেনটিটি। আমার স্যার, নমশূদ্র ছাড়া মানুষ নাই, বরিশাল ছাড়া দ্যাশ নাই।‘
‘যোগেন, যা কইছ–কইছ। আর কয়ো না। ধরো আমরা শুনি নাই। এ কথায় মানুষজন তোমারে ভুল বুইঝবে।‘