সেই বরিশাল-গান যখন তার কাগজে যোগেনের প্রশংসা করে তাকে বরিশালের মেগাস্থিনিস’ আখ্যা দিলেন, তখন ভোটাভুটিতে যেন যোগেনের পক্ষে জোয়ারের স্রোত ঢুকল। যোগেন, পৌষের মাঝামাঝি এই সকালে দুর্গামোহনের সঙ্গে, দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে। এসব কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা তখন তৈরি হয়নি, ঐ যোগেনের আসাতেই যা বোঝা যায় তা-ই। এসে, যোগেন আড্ডায় জমে গেল। সেখানে ছিলেনও শহরের দু-একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি। দিন চক্রবর্তী, বরদা ব্যানার্জি। দু-জনই বরিশাল বারের খুব বড় উকিল।
সাইকেল থেকে নেমে, ঘরে ঢুকে এঁদের দেখে, যোগেন বলে, ‘আইজ কি কোর্ট ছুটি, স্যার? দুই-দুইজনই এইখানে। জজশাহেবরাই-বা কইরবে কী, মক্কেলগুলাই-বা কইরবে কী। এইডা কী কথা, স্যার? আর, সাক্ষীগুলারে যে এত মিথ্যা কথা শিখাইল্যাম, সব তত ভুইল্যা যাবে নে।
বরদা-উকিলই বললেন–’তুমি তোমার ভোটের জায়গাগুলা ঘুরান দিছ?
‘এইডা কি একড়া সম্ভব কথা, স্যার? আমার কনস্টিটুয়েন্সি পুরাখান ঘুরান দিবার তো লর্ড লিনলিথগোও পারব না।‘
‘ক্যা? হইলডা কী?’
‘হইব আবার কী স্যার? ভাইসরয়ের না-হয় একশখানেক লঞ্চ-ইস্টিমার থাইকতে পারে কিন্তু স্যার কোন খালে কোন লঞ্চ যাবার পারে এইডা কে ঠিক করব? এইডা কি একড়া কনস্টিটুয়েন্সি স্যার? এইডা তো একখান মহাদেশ। তিন-তিনখান সাব-ডিভিশন, সদর, নর্থ, সাউথ, আর ভোলা। ষোলডা থানা। যে যে-জায়গার লোক, সে ছাড়া কেউ সেই জায়গা চিনে না। যাব ক্যামনে?
‘তার লগেই তো সেনমশাই তোমারে মেগাস্থিনিস কইছেন। তুমি বরিশালের আবিষ্কারক। তো কোর্টকাছারি পুরাপুরি বাদ দিয়ো না যোগেন। তোমার স্মৃতিশক্তির যা অবস্থা দেখি—’
‘কেন স্যার। আমার মেমরি তো ভাল। দ্যাহেন স্যার, মাঝখান থিক্যা কয়্যা দেই–
হেরো লয়ে মেঘ রাশ রাশ
লইয়্যা আলোক অন্ধকার
কী গাঢ় গভীর সুখে
পড়িয়া ধরার বুকে
নাহি ঘৃণা নাহি অন্ধকার।’
‘বাঃ বাঃ, তোমারে তো ‘দাঁড়া কবি’ টাইটেল দেয়া উচিত।
খাড়ায়া খাড়ায়া বানাইয়া দিল্যা?’
‘স্যার, এই কাব্যটি আমার জিভে আসে। অক্ষয় বড়াল মশায়ের।‘
‘না। জিগাইল্যা না–আজ কোর্টে যাই নাই ক্যান?’
‘সেডা তো এহনো জিগাই স্যার।‘
‘তুমি গেছিলা? না যাইবা?’
‘যাইব স্যার, এখান থিক্যা বাড়ি, দুইড়া মুখে দিয়া কাষ্ঠাহরণে যাইব।‘
‘যাইও না।’
‘ক্যান স্যার? এতগুলা প্রাণীর আহার! কাষ্ঠ আইনব্যার লাগব না?’
‘আজ-না সম্রাট বদলের ছুটি? তোমার মেমরি তাহলে তো ভালই। আর দিন কয়েক পরেই তো তুমি হইবা এমএলএ আর ষষ্ঠ জর্জ হইবেন কিং এমপোর।‘
‘হ তাই তো! ৩১ ডিসেম্বর তো অষ্টম এডোয়ার্ড-এর সিংহাসন ত্যাগের দিন। হ স্যার। মুহুরি হালদার মশাই তো সেরেস্তা ছাইড়্যা মাথায় গামছা বাইন্ধ্যা ভোট কইরবার গিছেন কোথায়-না-কোথায়। ডায়রিখানাও দিয়্যা যান নাই।
‘মুহুরি একখান পাইছ যোগেন–শিবু হালদার।‘
‘কী কইব স্যার, শিবুবাবুরে আমি কইলাম, তুমি আমার মুহুরি নাকী আমি তোমার মুহুরি। কইরল কী কাণ্ড? নমিনেশন ফর্ম জমা দেওয়ার আড়াইশ টাকা পাব কুথায়। আর তহন আমি ভোটে খাড়াইতেও চাই না। শিবু কোথা থিক্যা টাকা আইনল, আরো কার কাছ থিক্যা কী নিল আর আমারে দিয়া সই করাইয়া নমিনেশন জমা দিল।‘
‘অন্তত এই একডা কারণে শিবুর কাছে আমাগ কৃতজ্ঞ থাকা দরকার। সেই তো সঙ্গলের আগে বুইঝছে–বরিশালের একখান নূতন নেতা দরকার। অশ্বিনী দত্তের নাম ভাঙানোর দিন শ্যাষ। এহন তো নতুন নেতা দরকার,’ দুর্গামোহন সেনের কথা বলায় জিভে একটু আচমকা বাধা আসে। সেই কারণেই একটু কম কথা বলেন।
‘কী যে কন স্যার,’ স্বাভাবিকভাবে দুর্গামোহন সেনকে তো তার জ্যাঠাই বলা উচিত, কিন্তু যোগেন জানে, তার মত এক নমশুদ্রের জ্যাঠা হতে তাদের আপত্তিও থাকতে পারে। তাই, সে ‘স্যার’ এই শব্দটিই বেছে নিয়েছে।’
‘স্যার’ শুনলে টাউনের বাঙালি বামুন-কায়েত-বৈদ্য খুশিই হয়।
‘কী যে কন স্যার–আমার নি শিবুর কথায় ভোটে খাড়ানো সম্ভব ছিল? সোজা হিশাব দেইখ্যা একটুখান লোভ হইছিল। কংগ্রেস আর দুই স্বতন্ত্র যদি ভোটগুল্যা ভাগ কইর্যা দ্যায়, মাঝখান দিয়া আমি গইল্যা যাইতে পারি। সে লোভখান চাগাইতে-চাগাইতেই তো কীর্তিপাশার শীতাংশু রায়চৌধুরি স্যার উইড্র কইরলেন। আমার ভোটের শখও মিলাইয়া গেল। অ্যাহন তো রণক্ষেত্রে সরলকুমার দত্ত স্যার আর এই অভাগা। তাই তো কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট আর অশ্বিনী দত্তের ভাইয়ের বেটা আর জমিদার। এক্কেরে মাহেন্দ্র যোগ। আমারে তো নস্যির নাগাল টাইন্যা নিবেন। তো কইল্যাম, শিবুবাবু, উইড্র করেন নমিনেশন। কিন্তু শিবু কইরল উলটা কামন–আপনাগো জানাইল, স্যানসারডে জানাইল, পাঁজিপুঁথি পাড়ার পণ্ডিতস্যারকে জোট কইরল। মনোরঞ্জন স্যার আইস্যা খুউব একচোট গালি দিলেন–হ্যারামজাদা, ভোট কি তোর একার যে তোর খাড়া হইবার হাউশ হইলে খাড়াবি আর সইরা যাবার হাউশ হলি সইর্যা যাবু। ভোটর ফল তো ভোটে। কিন্তু ভোটের আগেই একখান্ জিত্ তো আমার হইয়া গিছে, স্যার।‘
‘সেইড্যা কী। খুইল্যা কও।
‘সে স্যার আপনাগ কারণে। আমি তো শিডিউল সিটে খাড়াই নাই। আপনারাই স্যার এই নমশুদ্রকে হিন্দু বইল্যা সম্মান দিলেন।‘
‘হিন্দু সিট কও ক্যান? জেনারেল সিট কও।‘