যোগেনের এই প্রকাশ্যতা ও স্পষ্টতা সকলের চেনা হয়ে যাচ্ছিল আর তা থেকে তার ওপর একটা ভরসা তৈরি হচ্ছিল।
বোধহয়, আর একটা বড় কারণ ছিল, গোপনে।
বরিশাল অশ্বিনী দত্তের দেশ। এত দুরে, এত দুর্গম একটি জেলাকে সারা বাংলায় যে প্রাধান্যে তিনি নিয়ে গেলেন, সে বরিশালবাসীর গৌরবকথা। জনসেবা, শিক্ষা, জাতিবৈরিতার অবসান, এক নাগরিক সমাজ তৈরি করে তোলার দরকার ও এক সামাজিক নৈতিকতা, তার কাছ থেকে বরিশালবাসী শিখেছিল ও বরিশালের কাছ থেকে সারা বাংলা শিখতে চাইছিল। দূরত্ব ও দুর্গমতা হয়ত বরিশালকে এমন সমষ্টিবদ্ধ জীবন তৈরি করার পক্ষে দরকারি বিচ্ছিন্নতা দিয়েছিল। বরিশালের বিচ্ছিন্নতা ছিল বরিশালবাসীর একক বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন। ও কতকটা উদ্ভট এক স্থানপ্রেমের অনড় অবলম্বন।
কিন্তু অশ্বিনী দত্তের সময় থেকে বিশ-তিরিশ বছর পর তার কর্মসূচির প্রাসঙ্গিকতা কমে আসছিল। যেন মনে হতে শুরু করেছিল যে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে স্বাদেশিকতার সাধনা হয়ে উঠছে গূঢ় কিছু ধর্মাচরণের মত। তার সঙ্গে বরিশালের খুব একটা বাঁধন কিছু নেই। বরিশাল খালবিলের দেশ, পঞ্চাশ পা যেতে হলেও সেখানে একটা খাল পেরতে হয় আর সেইসব খালে ভরা জোয়ারের জল সমুদ্র থেকে কলকলিয়ে বয়ে আসে প্রায় সব বাড়ির পৈঠায় দিনে বার কয়েক। বরিশাল জুড়ে নমশূদ্র আর মুসলমান জনগোষ্ঠী ছড়ানো বামুন-কায়েত-বৈদ্যরা খুব নামডাক নিয়ে আছেন তারা তাদের গ্রামগুলিকে শহুরে করে নেন। এখানকার বেশির ভাগ মুসলমানই ফরাইজি। বিরিশালে একদিকে ‘ভক্তিযোগ’, অন্যদিকে বামুন বৈদ্য-মুসলমান সকলেই আর, নমশূদ্ররা ছড়িয়ে আছে অসংখ্য জমিদারির চাষী হয়ে। বরিশালের জমিদারির ব্যবস্থাও আলাদা–একজন মধ্যস্বত্বভোগীর জমি থেকে ধাপে-ধাপে নেমে গেছে উপস্বত্বভোগীরা। নামডাকের জমিদারিও কিছু কম ছিল না–কীর্তিপাশা, বাটাজোড়, কোদালধোয়া, গৌরনদী, হিজলা। একবার এক হিশেবে বেরিয়েছিল এক জমিদারির জমিদার থেকে রায়ত পর্যন্ত উনিশজন উপস্বত্বভোগীর ধাপ।
১৯১১-এর সুমারিতে সারা বাংলায় নমশুদ্রের সংখ্যা গোনা হয়েছিল প্রায় ২১ লক্ষ। এর পরের সুমারিগুলোতে জাত জানাতে আপত্তি শুরু হয়ে যায়। ১১ সালের সুমারিকেই প্রামাণিক ধরা যায়। এই প্রায় ২১ লক্ষ নমশূদ্রের ছ-আনি, আট লাখই, থাকত–বাখরগঞ্জ, দক্ষিণ ফরিদপুর, নড়াইল, মাগুরা, খুলনা, বাগেরহাট মিলিয়ে যে-ডাঙা, সেখানে। এগুলো সবই ১১ সালের হিশেব। ১৯২০ থেকেই সরকার ভাঙনের নদীর চরে দখল মেনে নিতে শুরু করে। সেই চরের দখল নিতে জমিদাররা এই নমশুদ্র আর মুসলমান জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাত। তখন থেকেই এই স্থলদেশ একটা মারামারি-কাটাকাটির জায়গা হয়ে যায় কিন্তু তাতে হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি ছিল না।
বরিশালের এই জলময় পশ্চাদভূমির সঙ্গে বরিশাল শহরের সম্পর্ক ছিল একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে। এমন বোধহয় আর কোনো জেলায় ছিল না। সদরে বাংলাখ্যাত ব্রজমোহন কলেজ, হাইস্কুল, ব্রাহ্মসমাজ, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকা, কংগ্রেস ও অন্যান্য দল, কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, কলকাতার নেতাদের মিটিং। নমশূদ্রদের যারা নেতা ছিল তারা যদি-বা ২০-২৫ সালে জনগোষ্ঠীভিত্তিক নানারকম আন্দোলন করেছে, সেসব আন্দোলন বেশিরভাগটাই ছিল হিন্দু বর্ণসমাজে নমশূদ্রদের জায়গা ওপরের দিকে তোলার চেষ্টা। ৩০ সাল নাগাদ সেই নেতারা কৃষক-নমশূদ্রদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি–তখন কাউন্সিল, লোকাল বোর্ড আর ইউনিয়ন বোর্ডে ঢোকার হাওয়া। নমশূদ্রদের নেতাদের অনেকেই কংগ্রেসের ও নেতা হয়ে গেছে কেশবচন্দ্র দাস, মোহিনীমোহন দাস। ফজলুল হক কৃষকপ্রজা পার্টি তৈরি করেছিলেন। সে পার্টি মুসলিম রাজনীতির এই ফঁকটা ভরে দিল বটে কিন্তু তপশিলি জাতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। নমশূদ্র নেতারা কেউ বর্ণাশ্রম ও শূদ্র দাসত্বের কথা ভাবেনি। নমশূদ্রেরা না-ঘরটা না-ঘাটকী হয়ে থাকল। তাই তপশিলি জাতির জন্য আসন সংরক্ষিত রেখে প্রায় সর্বজনীন ভোটাধিকার দিয়ে ৩৭ সালের যে ভোট হল–সেটাকে উপলক্ষ করেই বরিশালে নমশূদ্রদের নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়ে গেল নিজে থেকেই। তৈরি হওয়ার পর বোঝা গেল, সেই নেতৃত্বের প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি–যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বিএ, বিএল, যে মাত্র ৩২ বছর বয়সে বরিশাল বারে ঢুকল আর বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই আইনসভার ভোটে দাঁড়াল সাধারণ আসন থেকে, সংরক্ষিত আসন থেকে নয়। কেন, কী-সেটা আলাদা ঘটনা। আর-একটু পরে, আরো বোঝা গেল–যোগেনের মত নেতা পাওয়ার ফলেই ফাঁকটা চেনা গিয়েছিল। বরিশালের একটা নেতা চাই। এই ভোটেরই দিনপনের আগে বরিশাল টাউন হলের সেই সভা, যোগেন যেখানে উপযাচক হয়ে বক্তৃতা করেছিল। সেই বক্তৃতা শুনে ‘বরিশাল হিতৈষী’-র সম্পাদক দুর্গামোহন সেন এতটাই মুগ্ধ হন যে তার কাগজে যোগেনকে নতুন বরিশালের নতুন নেতা, ‘বরিশালের মেগাস্থিনিস,’ বলে বর্ণনা করেন।
দুর্গামোহন সেন কংগ্রেসি, যেমন যে আর-কিছু না, সে কংগ্রেসি। তার খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা ছিল নির্ভীক সত্যভাষণের জন্য। তাকে নিয়ে একটা প্রবাদই চালু ছিল, বরিশাল-গান’। মেঘনায় যখন সমুদ্র থেকে বাঁড়াষাড়ির বান ডাকত, তখন, কখনো-কখনো কামানের গোলা ফাটার মত আওয়াজ হত। তার কারণ খুব একটা স্পষ্ট করে জানা যায়নি। তাকে বলত, বরিশাল-গান, ইংরেজি gun। দুর্গামোহন কখনো কাউকে প্রশংসা বা সমর্থন করতেন না। তার মতামতে একটা হুল থাকতই। সে-কারণেই তার মতামতের দামও ছিল খুব উঁচু।