সবচেয়ে বেশি রাত জাগতে হয়েছে মুদ্ৰক দিলীপ দে-কে। দিলীপ কিছুতেই কেন যে হাল ছাড়েননি!
আমার প্রধান প্রকাশক সুধাংশুশেখর দে আমাকে শুধু আরো নির্ভরশীল করে তুললেন দু-বছরের বেশি সময় ধরে বইটি ছাপানোর প্রক্রিয়া সয়ে।
আমার বন্ধু অরুণ সেন লেখালিখি সংক্রান্ত সব ব্যাপারেই আমার ভরসা ও চিরসখা। ফোন, ইন্টারনেট, বইপত্র, ম্যাপ জোগাড়, লোকজনের হদিশ এত সব জটিলতা অরুণই সামলেছেন।
দেবেশ রায়
নববর্ষ, ১৪১৭
বল্মীক আবাসন
কলকাতা ৭০০ ০৫৯
.
অধ্যায়সূচি
.
০০১. যোগেন মণ্ডল বরিশালের মেগাস্থিনিস
‘আরে, মুই–না চব্বিশ ঘণ্টার উপুর আরো চব্বিশ চাপ্যাইয়া–না নাগাড়ে কই, বাবু, মুই হিন্দু, মোর বাপ–চোড্ড পুরুষ হিন্দু, মোর নাতি-নাতনিরা চোদ্দও হিন্দুই হইব, আমাগ তো হিন্দু না হইয়্যা কুনো উপায় রাখেন নাই। বাবুরা চইঠ্যাই থাহে, ব্যাডা তুই হিন্দুই তবে এক পোয়া কম। মুই কই তাইলে মোর ঐ খালাশ এক পোয়াডায় মুই জল মিশাই–স্যায় খালেরল জল নদীর জল যাই হোক, তার লগে তো আপনাগ কোনো নিষেধ নাই আমাগও কোনো প্রাচিত্তির নাই। কিন্তু বাবুরা তো বাবু তাইলেও বরশালিয়া বাবু। একবার যদি রগ চইড্যা। চইড্যা যায়, আর নামা নামি নাই। কয়–বেটা নম, তোগো আবার পুরাপুরি চারপোয়া ক্যা রে। যা, ঐ এক পোয়া কমই থাকবি।’
নিজের কথায় যোগেন মণ্ডল নিজেই হেসে ওঠে তার সুস্থ, স্বাস্থ্যল, পেশল শরীরে ছড়ানো তেত্রিশ বছর বয়সের যৌবন নিয়ে। তার সেই খোলা আওয়াজের হাসিতে গোপন প্রতাপের প্রকাশ একটু অমীমাংসিত থাকে। না-হয় বরিশাল সদর আদালতে ঢুকতে-না-ঢুকতেই নামগাম করেছে, না-হয় বারে যোগ দেওয়ার আগেই ভোটে জিতে লোকাল বোর্ডের মেম্বার হয়েছে, না-হয় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে মনোনীত মেম্বার, আর দিন-পনের পরে এমএলএ ভোটের প্রার্থী, কিন্তু এর কোনো একটি কারণে বা সবগুলি কারণ এক করে দিয়ে একটা কারণ তৈরি করে নিলেও, একজন নমশূদ্রের পক্ষে এমন একটা বৈঠকে এতটা জোরে এতক্ষণ ধরে হাসাটা, একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? যোগেনের হাসিটা শেষ হওয়ার মুখে তার ঠোঁটের বিস্তার কমে এলে তার সম্মুখপাটির দাঁতগুলি যেমন দেখা যায়, তাতে কারো মনে হতেও পারত, যোগেনের একেবারে ভিতরে একটা আক্রমণ যেন লেজ ঝাঁপটাচ্ছে। লেজই ঝাঁপটাচ্ছে বটে তবে দৃষ্টি, যোগেনের দৃষ্টি, সম্পূর্ণ লক্ষনিবদ্ধ নয়–যেন লক্ষ নিয়ে দ্বিধা ঘটে যাচ্ছে।
বাংলা তেতাল্লিশ সালের পৌষের মাঝামাঝি বরিশাল শহরের বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘বরিশাল হিতৈষী’র ছাপাখানায় বসে কথা হচ্ছিল মালিক, প্রকাশক, মুদ্রক, সম্পাদক ও একাই একশ দুর্গামোহন সেনের টেবিল ঘিরে। টেবিলটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না–এত নানা সাইজের কাগজের স্তূপ। সেই স্তূপের ভিতর থেকে অনেক কাগজের লালচে কোনা বেরিয়ে আছে–সেগুলো যে কতই পুরনো তার নিশানা দিয়ে। একটি কোণে পাঁজা করা পুরনো পাঁজি। ওপর থেকে একটা আলো ঝোলানো, টেবিলের মাঝামাঝি, কেরোসিনের লম্বা চোঙের আলো, চোঙের মাথায় একটা কাগজের ঘের বসানো, আলো যাতে ছড়িয়ে না পড়ে। টেবিলে দুর্গামোহন সেনের সামনে বরিশালের যোগেন মণ্ডল একটু জায়গা, পৌনে একহাত মত, আর তার মুখোমুখি চেয়ারটার সামনে খানিকটা, বিঘতখানেক, ফাঁকা–কাজের দরকারে। ঘরের ভিতর দুটো বড় র্যাকে ‘বরিশাল হিতৈষী’ স্তূপ করা, আর-একটাতে শাদা কাগজ, দু-তিন সাইজের। দুর্গামোহন সেনের টেবিল ঘিরেই ইতস্তত ছড়ানো ছ-সাতটি কাঠের ও টিনের চেয়ার। এর বাইরেও বারান্দার দিকে দুটো-একটা টুল ছিল। এগুলো কম্পোজিটারদের টুল–এখন ভিড় সামলাতে এখানে দেয়া হয়েছে।
যা হচ্ছিল, দুদিন আগে টাউন হলের সাধারণ সভার ঘটনা নিয়ে–মাস দেড়েকের মধ্যে ৩৫ সালের ‘ভারতশাসন আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক আইনসভা তৈরির প্রথম ভোট। সভাপতির ভাষণের জায়গায় যখন সভা পৌঁছেছে যোগেন মণ্ডল দাঁড়িয়ে জানায়, সে কিছু বলতে চায়। সভাপতি ঠিক বুঝতে পারে না, কী করবে। সে বলে উঠল, ‘কিন্তু তুমি তো ক্যানডিডেট!’ যোগেন হেসে উঠে বলে, ‘তার লগেই তো কবার চাই। নাকী বরিশাল নিয়্যা আমার ভাবন-কহন প্রহিবিটেড হইয়া গেল নাকী? আমি তো ভাইবছিলাম উলটা। নাইলে আমার ভোটে দাঁড়ানোর কামডা কী ছিল? সবে তো সেরেস্তা খুইলছি, ভোটে জিতলে তো ওকালতির হাঁড়ি শিকায় উঠব। আর, ভোটে হাইরলে তো নাম হইব নে–হারুয়া উকিল, মামলা জিইতব্যার পারব না। ভোটের কথা ছাড়ান দ্যান। আমার কথা আছে–বরিশালের লাইগ্যা, খালবিলের লাইগ্যা, ইশকুল-কলেজের লাইগ্যা। কইব্যার দিবেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, স্যার?’
ততক্ষণে সভা থেকেই কথা ওঠে।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।‘
‘আরে যোগেনেরই তো আগে ডাকা দরকার ছিল।‘
‘ওর মত কেউ চেনে নাকী বরিশাল?’
‘কও, কও।
যোগেন মণ্ডল তখন বরিশালের একজন এমন নেতা হয়ে উঠছে, যার কথার দিকে কান আর কাজের দিকে নজর রাখতে শুরু করেছে টাউনের মানুষজন। বারে যোগ দিতে-না-দিতেই কয়েকটা কেস এমন জিতল যোগেন, যে কারো কোনো সন্দেহ থাকল না-যোগেন বরিশালের প্রধান উকিলদের একজন হবেই। তার ওপর তার ইংরেজি বাগ্মিতা সহজেই মুগ্ধ করত। সেই মুগ্ধতার মধ্যে এমন একটা অতিরিক্ত তারিফও গোপন থাকত–ব্যাটা নমো-র ছেলে, ইংরেজি কয় য্যান্ কার্ভালো। বরিশালে তখন ‘কেদার রায়’ যাত্রার খুব চল ছিল। যোগেনের সিনিয়ার ছিলেন, বরিশালের একডাকে চেনা উকিল কুলদারঞ্জন দাশগুপ্ত। যোগেন তোটটোটে দাঁড়ানোয় তিনি বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন, ইংরেজিতে, ইভেন ইফ ইন্ডিয়া গেটু ফ্রিডম, হোয়াট উড শি ডু উইথ দিস ইরিট্রিভিবল লস অব সাচ এ ব্রিলিয়ান্ট অ্যান্ড রেয়ার লিগ্যাল ব্রেন টু পলিটিকস। কুলদারঞ্জনের রাগ কমাতে যোগেন তাকে আশ্বস্ত করতে বলেছিল, ‘কীই যে কন স্যার, ওকালতি না কইরলে বাড়িতে হাঁড়ি চইড়ব ক্যামনে?’