০০১. যোগেন মণ্ডল বরিশালের মেগাস্থিনিস
এই নভেলটি ১৯৩৭ থেকে ৪৭-এ বাংলায়। একমাত্র বাংলাতেই, যা সব ঘটনা ঘটেছে ও সে-সব ঘটনার ফলে বাংলা সারা ভারতের শাসননীতি ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে, তার নানা গল্প।
———–
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃত এখন। ১৯৩৭ থেকে ৪৭ এই দশটি বছরে তিনি ছিলেন বাংলার নমশূদ্রদের অবিসংবাদী নেতা। বাংলার ও ভারতের রাজনীতিতে পরে তিনি প্রধানতম বিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩-এ খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন। ৪৬-এ পূনর্নির্বাচিত হয়ে সারওয়ারদির মন্ত্রিসভাতেও। ১৯৪৬-এ তিনি। মহম্মদ আলি জিন্না কর্তৃক অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভায় মুসলিম লিগের প্রতিনিধি মনোনীত হওয়ায় হিন্দু ও মুসলিম দুই জাতেরই শত্রু হয়ে পড়েন। তিনি পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫০-এ কলকাতায় চলে আসেন। আম্বেদকর ও যোগেন মণ্ডল তাদের ক্ষুদ্রতার কারণে কোনো জাতীয়তাবাদেই গৃহীত হন নি। কিন্তু বহু নিন্দা ও বিরোধিতার পর কংগ্রেস দলিত-ভোটের জন্য আম্বেদকরকে জাতীয়-আখ্যানের দেবমণ্ডলিতে জায়গা করে দেয়। বাংলা বিভক্ত হওয়ায় যোগেন মণ্ডল সম্পর্কে তেমন কোনো দায় বা ভয় জাতীয়তাবাদীদের ছিল না। তাকে তাই ইতিহাস থেকে স-ম্-পূ-র্ণ মুছে দেয়া হয়েছে। তাঁর নাম এখন কোনো স্থানীয় ইতিহাসের ফুটনোটেও থাকে না।
———–
বাংলা ছিল মুসলিম প্রধান ও তপশিলিজন অধ্যুষিত। কংগ্রেসের হিন্দুওয়ালা নেতারা সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে তাড়ালেন। মুসলিম লিগের অবাঙালি নেতারা ফজলুল হককে লিগ থেকে তাড়ালেন। ব্রিটিশ যুদ্ধনীতি পূর্ব পরিকল্পনামত সিঙ্গাপুর, মালয়, ব্রহ্মদেশ ও থাইল্যান্ড থেকে পশ্চাদপসরণ করে বাংলাকে যুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গন করে তোলে। ফলে, নিম্নবঙ্গকে ধ্বংস করে দেয়া হল ও যুদ্ধের রেশন চালাতে বাংলায় ঘটল ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ। ৪৫-এ ম্যালেরিয়া মহামারী। ১৯৪০ পর্যন্ত ও ১৯৪৫-এর পর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ছিল বাংলার নিজস্ব রাজনীতি।
ভারতের অন্য কোনো প্রদেশ থেকে বাংলা কোনো প্রকার সাহায্য পায়নি। এমনকী সর্বাধিক সংখ্যক রাজবন্দীদের জন্যও তারা জেলখানায় জায়গা দেয়নি।
এই নতুন সময়ে বাংলার তপশিলি নেতা বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন অবিসংবাদী শূদ্রনেতা। তিনিই প্রথম বলেন, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের রক্ষা করা শূদ্রদের কাজ নয় ও মুসলমানদের সঙ্গে শূদ্রদের শ্ৰেণীগত মিল অনেক বেশি। এই শূদ্র যোগেন মণ্ডলই একমাত্র ভারতীয় যিনি পাকিস্তানকে তাঁর স্বদেশ বলেছিলেন ও সেই কালবেলায় ভারতবর্ষ-ধ্যানটিকে রক্ষা করেছিলেন।
—————
বরিশালের যোগেন মণ্ডল – উপন্যাস – দেবেশ রায়
প্রথম প্রকাশ : বৈশাখ ১৪১৭, এপ্রিল ২০১০
.
উৎসর্গ
বেণুমাসিকে
বেণুমাসি ছিলেন আমাদের মাতৃসমা। তিনি সারাজীবন আমাদের লালনপালন করেছেন।
দেশ থেকে জলপাইগুড়িতে যখন চলে আসি আমরা, ৪৩-এ, বেণুমাসি তো তখন আসবেনই। ১৯৫৩ পর্যন্ত সমরেশ ছিল আমাদের সবচেয়ে ছোটভাই। সমরেশের জন্মের পর মা এমন অসুখে পড়েন যে তাকে স্থানান্তরে নিয়ে যেতে হয়। আমরা ভাইবোনরা কখনো-সখনো ভাবতাম মা আর বেঁচে নেই। কিন্তু বেণুমাসি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।
সমরেশকে লালন করেছেন। সমরেশ তার ছোট মা-র কাছেই খেত-শুত। আমার মা-কে বেণুমাসি ডাকতেন ‘বৌমা’ বলে। এমন ভাবতে চাই এখন, এমন ভাবতে ভাল লাগে, আমরা ভাইবোনরা শুদ্ৰাণী-পালিত বংশ।
এই উপন্যাসটির গল্পটুকুতে আমার সেই বাল্য-কৈশোর-প্রথম যৌবনের পারিবারিক শুদ্রপ্রচ্ছায়া চিনতে পেরেছি, রচনার সময় জুড়ে বেণুমাসির গলার স্বর শুনতে পেয়েছি ও ভারী কাজের ওতপোত বিষণ্ণ ক্লান্তিতে বেণুমাসির অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় সেরেও উঠেছি।
এ-লেখাটি বেণুমাসি ছাড়া কাউকে দেয়া যায় না।
নববর্ষ ১৪১৭
.
কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন
যে-কোনো আক্কেলে মানুষই বুঝবেন–পুরনো একটি সময়, অনেকেরই জানা ঘটনা ও মানুষজন নিয়ে এত জনবহুল ও পৃষ্ঠাবহুল একটি লেখা কত মানুষের কত রকম সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। শিল্পকর্মের তেমন কোনো কৃতজ্ঞতার দায় স্বীকার করা অনর্থক। কিন্তু যদি কারো শারীরিক শ্রম নিয়ে থাকি, তা স্বীকার না-করা ঋণখেলাপি।
সমরেশ রায়, আমার ভাই, যা খেটেছে সেটাই এই বইটি লেখা হয়ে-ওঠার প্রধান একটি কারণ। বাংলাদেশের শামীম রেজা ও অন্যান্য বন্ধুরা হাত-উজাড় সাহায্য করেছেন। অধ্যাপক বন্ধু স্বপন পাণ্ডা, শাশ্বতী মজুমদার, মণিময় মুখোপাধ্যায় এঁরা নিজেদের শরীরের অসুবিধে, ও শেষ দু-জন কলকাতা আসা-যাওয়ার নিত্য বাধা, যে-অনায়াসে উৎরে এই এত বড় লেখার প্রফ একাধিক বার দেখে দিয়েছেন সেটা যেন রহস্যময় ঠেকে। শাশ্বতীই একমাত্র নানা আকারে পুরো পাণ্ডুলিপি অনেকবার পড়েছেন ও তার স্বাধীন মত-অমত জানিয়ে আমাকে সংস্কারে সাহায্য করেছেন। অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বদলি, টানা ও পাকা প্রুফের ও অনবরত বদলের ঝামেলা মিটিয়েছেন। সিতশ্রী ভড় ম্যাপগুলো এঁকে দিয়েছেন আমার আবছা ইচ্ছে অনুমান করে। বর্তমানে দিল্লিবাসিনী নিবেদিতা সেন-এর আঁকা অনেক ছবি দেখছিলাম–তাঁর কল্পনা ও সামর্থ্যে মুগ্ধ হয়ে। এই ছবিটি তিনি প্রচ্ছদে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।