বর্ষা আসে তার কেশপাশ এলিয়ে-দুলিয়ে। মেঘভার আকাশ, মাঝে মাঝে মেঘের ডাক– শিশুমনে ভীতির সঞ্চার করে। মেঘমেদুর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে কী আনন্দ না জাগে! অঢেল বর্ষা। এ বর্ষা বুঝি থামে না। মাঠঘাট ডুবে যায়, জলা-ডাঙা সব এক হয়ে যায়। ছেলেরা মাছ ধরতে যায়। জলে উজান নিয়ে মাছ উঠছে। মাছ ধরার আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। বর্ষাঘন সন্ধ্যা। ঝিল্লির ডাকমুখর সন্ধ্যা। বাগানের কোনো কোণে একটা বিরহী পাখি যেন ডাকছে–বউ কথা কও। রাত্রি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ ফিকে হয়ে আসে–ক্রমে আকাশ পরিষ্কার হয়। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে চারিদিক। নীল নিবিড় আকাশে জ্যোৎস্নার অনন্ত উচ্ছ্বাস। সেদিকে তাকিয়ে কত কী ভাবি। আকাশের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক। নাড়ির সম্পর্কের চাইতেও যেন গভীর। এই সম্পর্ক অনন্ত জীবনের সঙ্গে জীবনের। নদনদী, গাছপালা সবই যেন ধরা দেয়। কবে কোন অতীতে যুগ-মধ্যাহ্নে কোন তাপস কোন বৃক্ষের তলায় তপস্যা করে হয়েছিলেন ঋষি জানি না। আবার কত মানুষ শুধু পথ চলেছে– পথ, পথ আর পথ, তাদের পথ চলার সঞ্চয় রেখে গেছে ভাবীকালের জন্যে। কত ঘুমভাঙা রাত্রি তারা জেগে কাটিয়ে দিয়েছে। মনে হয় তেমন রাত্রি যেন বারবার আসে, আসুক মহাজীবনের আহ্বান জানিয়ে–আসুক, স্বপ্নের বেসাতি নিয়ে। আসুক রঙিন ফানুস হয়ে, তবু আসুক।
চাষিরা চাষ করে। জেলেরা জাল ফেলে। পাটনিরা খেয়া পারাপার করে, কুমোররা তৈরি করে হাঁড়ি-কলসি। মধুসূদনের বাজার বসে, সবাই একহাটে এসে কেনা-বেচা করে। মাঝে মাঝে গ্রামপ্রান্তে মেলা বসে। মেলায় গিয়ে কতদিন নাগরদোলায় চড়েছি। পুতুল খেলা দেখেছি। সীতার দুঃখ দেখে চোখের জল ফেলেছি। লক্ষ্মণ-ইন্দ্রজিতের যুদ্ধ দেখে অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। মেলায় যাত্রাগান হয়। দেশ-দেশান্তর থেকে যাত্রাদল আসে। অভিমন্যুর বীরত্ব দেখে হাততালি দিয়েছি। মনে মনে ভাবি, আমি যদি অভিমন্যু হতাম। দলু দত্তর গান শুনেছি– এম এ বি এ পাস করে সব মরছে কলম পিষে; বলি, বাঙালি বাঁচবে আর কীসে? মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে আসি। কত আনন্দ ছিল সেদিন।
খেলার ধুম পড়ত। কেদার-মাঠে ফুটবল খেলার শেষে সবাই ইছামতীর ধারে বেলতলাঘাটে গিয়ে বসি। জ্ঞানদার দোকানে ভিড় করি। চায়ের দোকানটা ভালোই চলে। গান চলে, গল্প চলে। পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারাটা কেবলই জ্বলে। ওপারের আলো চোখে ভাসতে থাকে। ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বাজে।
পুজোর কটা দিন চলে যায়। বিজয়ার দিন কীসের বিয়োগব্যথায় যেন সকলের চোখে জল নেমে আসে। নদীর বুকে ভাসে হাজার হাজার নৌকা বাইচ খেলা হয়; বাজি ফোটে। কত আনন্দ অথচ কত দুঃখে মানুষের মন ভারী হয়ে ওঠে। বিজয়ার শেষে সবাই আসে–সবাই আলিঙ্গন করে সবাইকে। রাত্রিতে বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়াই। বিপ্লবী দাদাদের কথা মনে পড়ে। আজ তারা কোথায়? যিনি আমাকে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন সেই শচীন সরকারই বা কোথায়?
শীতকালের কথা বেশ মনে পড়ে।
গ্রামবাসীদের শীতের পোশাক বড়ো জোটে না। তাই ভোরবেলা তারা গাছের পাতা বিশেষ করে নোনাপাতা জোগাড় করে আনে, তাই দিয়ে আগুন করে। তারা আগুনের চারপাশে এসে ভিড় করে বসে। আগুন পোহায়।
এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমার পূর্বপুরুষ যারা এই উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল আজ তাকে ছেড়ে যেতে হবে আবার নতুনের সন্ধানে। আবার যে নতুন উপনিবেশ গড়ে উঠবে তাকে এমনই আপনার করে আর পাব কি?
.
ডাকাতিয়া
বাংলার গ্রাম আজ কথা বলেছে; নিজের কথা, লক্ষ লক্ষ সন্তানের কথা। শুনে মনে জাগছে। আমারও জননী-জন্মভূমি ছেড়ে আসা গ্রামে’-র হৃদয় নিঙড়ানো স্মৃতি। বাংলাদেশের লক্ষ গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম। যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি সে-গ্রামকে ভুলতে পারি না। সে-গ্রামের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক, আমার নাড়ির টান। বহুদূরে পশ্চিমবাংলার উপান্তে এই মফসসল শহরে বসে আকাশ আর মাটির নীরব ভাষা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি। এখানেও গ্রামের মানুষকে আপন করে নিয়েছি। এরাও আমাকে আর শরণার্থী ভাবে না। আমি যেন এদেরই একজন। তবু কোনো এক বৃষ্টি ঝরা অলস অপরাহ্নে পশ্চিমবাংলার রৌদ্র-রুক্ষ এই অবারিত প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে মন চলে যায় বহুদূরে সেই সুদূর পূর্ববাংলায় স্নিগ্ধ ছায়ানিবিড় আমার জন্মভূমি ছেড়ে-আসা গ্রামের সেই নদী মাটি আর আকাশের আঙিনায়। মন বলে : যাই, আবার যাই।
ভাবি, আর কি ফিরে যেতে পারব না আমার ছেড়ে আসা মায়ের কোলে মা–আমার মাটির মা–সত্যিই কি পর হয়ে গেল আজ? মন মানতে চায় না। অব্যক্ত ব্যথায় ভাবাতুর হয়ে ওঠে। সহস্র স্মৃতি-সৌরভে জড়ানো মায়ের স্নিগ্ধ শ্যাম-আঁচলের পরশ কি আর এ জীবনে পাব না? লালাটে তাঁর সব ব্যথা-ভোলানো স্নেহ-চুম্বন আর কি সম্ভব নয়?
ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমাতে হল–এ কার অমোঘ বিধান? ঘরছাড়া মানুষ কি আর ফিরবে না ঘরে–তার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে? শরণার্থীর বেশে মানুষ আসছে দলে দলে–দেহ ক্লান্ত-মন বিষণ্ণ–দু-চোখে অশ্রুর প্লাবন। জোলো হাওয়ার দেশের ভিজে মাটির সবুজ তৃণলতা এরা; শেকড় উপড়ে কঠিন মাটির দেশে এদের বাঁচাবার যে চেষ্টা চলছে তা কি সফল হবে? প্রাণরসের অভাবে শুকিয়ে যাবে না কি ভাবী যুগের সোনার ফসল?