রাজনৈতিক জীবনে সেনহাটীর নাম উল্লেখযোগ্য। সেই ‘হিন্দু স্বদেশি মেলা’র যুগের বিপ্লবী নেতা স্বর্গত হীরালাল সেন থেকে আরম্ভ করে শহীদ অনুজা ও অতুল পর্যন্ত সকলেই গ্রামে সাধারণ সরল জীবনযাপন করতেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ একবার বিপ্লবী হীরালাল সেনের পক্ষে সাক্ষ্য দেবার জন্যে খুলনার আদালতে হাজির হয়েছিলেন। হীরালালবাবু কিছুদিন রবীন্দ্রনাথের কোনো জমিদারির ম্যানেজার ছিলেন। এই সূত্রে তাঁকে সাক্ষী মানা হয়েছিল। বিশ্বকবি বিনা দ্বিধায় সেই বিপদের দিনে বিপ্লবী হীরালালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই মোকদ্দমায় হীরালালের জেল হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে তার পরিবারের তত্ত্বাবধানের সকল ব্যবস্থা করেছিলেন। সেনহাটীর অনতিদূরবর্তী ‘দৌলতপুর’ গ্রামে বিপ্লবী কিরণ মুখার্জি প্রতিষ্ঠিত সত্যাশ্রম’ আমাদের গ্রামের তরুণদের মনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেখানেই অনেক বিপ্লবীর প্রথম দীক্ষা। আশ্রমটির কার্যকলাপ বাহ্যত সমাজসেবায় পরিস্ফুট থাকলেও এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের গ্রামেও অনুরূপ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। প্রবুদ্ধ সমিতি’ প্রতিষ্ঠানটি এদের অন্যতম। শহীদ অনুজা ও অতুল এই সমিতির সভ্য ছিলেন। আজ মনে জাগছে এঁদের মতো কত নিঃস্বার্থ তরুণ-তরুণীর আত্মদানে এই দেশের স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু তাঁদেরই, ভাই, বোনেরা সব আজ একটু আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা। তাঁদের শত আবেদন-নিবেদনেও রাজমসনদে বাদশাজাদার তন্দ্রা টুটে যায় না।
বিভিন্ন শ্রেণির লোকের বাস সেনহাটী। খ্যাত, অখ্যাত বহু লোকের জন্মভূমি এই গ্রাম। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের তিনটি বিশিষ্ট বাড়ি কবিরাজবাড়ি’, ‘বক্সীবাড়ি ও ডাক্তারবাড়িতে পুজোর তিন রাত্রি যাত্রাগান হত। স্থানে স্থানে শৌখিন সম্প্রদায়ের থিয়েটার হত। ‘ভেনাস ক্লাব’, ‘বান্ধব’, ‘নাট্যসমিতি’ ‘ছাত্র নাট্যসমিতি’ এ তিনটি শৌখিন নাট্য সম্প্রদায় তাদের অভিনয় নৈপুণ্যে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিল। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি এস, আর, দাশগুপ্ত, ব্যারিস্টার নীরদ দাশগুপ্ত প্রভৃতি ‘ভেনাস ক্লাবের’ সভ্য ছিলেন। এঁদের অভিনয় কৃতিত্বের কথা আজ গ্রামবাসীরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। নাট্যকার শচীন সেনগুপ্তও গ্রামের লোক। তিনিও এ গ্রামে কয়েকবার কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
এইসব যাত্রা, থিয়েটারে কত মুসলমান হিন্দুর পাশে বসে গান শুনতেন। কত মুসলমান ‘ধ্রুব’, ‘প্রহ্লাদে’র দুঃখে বিগলিত হতেন, ‘সীতাহরণ’ দেখে ক্রুদ্ধ হতেন। আজ সেইসব সরল প্রাণ গ্রামবাসী মুসলমান প্রতিবেশীরা কোথায়? বিজয়াদশমীর দিন সন্ধ্যায় নদীর তীরে অভূতপূর্ব দৃশ্যের সমাবেশ হত। প্রায় পঞ্চাশখানা প্রতিমা সারি সারি জোড়া নৌকার বুকে বাজনার তালে তালে নেচে বেড়াত। স্টিমারে করেও অনেক দর্শক আসত প্রতিমা বিসর্জন দেখার জন্যে। অসংখ্য নৌকার বাজনাদারদের বাজনার দাপটে ও নৌকা-স্টিমারের ভিড়ে এক মাইলব্যাপী নদী-পথে ‘সামাল সামাল’ রব পড়ে যেত। সমস্ত জায়গা জুড়ে একটা নৌযুদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টি হত। তারপর ‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে’ বিষণ্ণ চিত্তে সবাই ঘরে ফিরতেন। দশমীর প্রীতি আলিঙ্গনে পরিবেশ মধুর হয়ে উঠত।
ব্যাবসায়িক জীবনেও সেনহাটীর নাম ছিল উন্নত। গ্রামটি নদীতীরে অবস্থিত বলে নানাদেশের পণ্য, বিশেষ করে সুন্দরবন থেকে আনীত বহু জিনিস এখানে ক্রয়-বিক্রয় হত। গ্রামের প্রধান বাজারটি নদীতীরেই বসত–এ ছাড়া কয়েকটি হাট সপ্তাহে দু-একদিন গ্রামের অন্যত্র বসত। ক্রেতা-বিক্রেতারা বিভিন্ন শ্রেণির হলেও কিছু সময়ের জন্যে হিন্দু-মুসলমান সকলেই মিলেমিশে এক পরিবার বনে যেতেন—’খুড়ো’, ‘ভাই’ ‘দাদা’ সম্বোধনের পরিবেশে বিভিন্ন শ্রেণিগত লোকের এরূপ আন্তরিক মিলন আর কখনো সম্ভব হবে কি না কে জানে। এই হাট-বাজারেই গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশের সুখ-দুঃখের, আশা-নিরাশার কথা হত। সেসবই আজ স্বপ্ন বলে মনে হয়।
গ্রামের কয়েকটি প্রাচীন কীর্তি উল্লেখযোগ্য। সদ্ভাবশতক-এর অমর কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে বাসুদেব মূর্তি এক অতিপ্রাচীন কীর্তি। মূর্তিটি কষ্টিপাথরের বলে মনে হয় এবং উচ্চতায় হবে দু-ফুট, মূর্তির মাথায় কিরীট, পরিধানে আজানুলম্বিত কটিবাস, গলায় কটিদেশাবলম্বী বক্ষোপবিত ও আজানুলম্বিত বনমালা। দক্ষিণাধঃ-হস্তে পদ্ম, দক্ষিণোর্ধ্বে গদা, বামোর্ধ্বে চক্র ও অপর বামহস্তে শঙ্খ এবং দক্ষিণপার্শ্বে পদ্মহস্তা শ্রী ও বাম-পার্শ্বে বীণাহস্তা পুষ্টি দন্ডায়মানা। মূর্তির পদনিম্নে গরুড় ও গরুড়ের দক্ষিণে দুটি ও বামে একটি অপরিচিত মূর্তি। এই মূর্তি কোন সময়ে, কোথা থেকে, কার দ্বারা কীভাবে আনীত হয়েছিল সে-সম্বন্ধে কিংবদন্তি আছে।
সাড়ে চারশো বছর আগে সেনহাটী গ্রামের নরহরি কবীন্দ্র বিশ্বাস কামাখ্যাধিপতির রাজধানীতে কিছুদিন দ্বারপন্ডিত নিযুক্ত ছিলেন। এই সময় তিনি কামাখ্যা মহাপীঠস্থানে উৎকণ্ঠ তপস্যা করে মহামায়ার কৃপায় লক্ষ্মীদেবীর মূর্তিসহ বাসুদেব মূর্তি লাভ করেন। কিন্তু মায়াতরীযোগে গৃহে ফিরে এসে বাসুদেবের মূর্তি পূর্বে গৃহে নিয়ে যাওয়ায় লক্ষ্মীদেবী নৌকাসহ অন্তৰ্হিতা হয়ে যান এবং কবীন্দ্র আকাশবাণী শুনতে পান–আমাকে উপেক্ষা করে তুমি আগে ঠাকুরকে ঘরে নিয়ে গেছ–আমি তোমার ঘরে আর যাব না। তুমি ঠাকুরকে ভালোবাস, তাঁকেই পূজা করো–তাতেই তোমার মঙ্গল হবে। সেই থেকে বাসুদেবের মূর্তিটি সেনহাটীতে পূজিত হয়ে আসছে।