আজ বেশি করে মনে পড়ছে ‘মায়ের বাড়ি’র কথা। গ্রামবাসীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবেই ধরা হত ‘মায়ের বাড়ি’কে। এখনও পর্যন্ত সেই মায়ের কথা চিন্তায় এলেই আপনা আপনি কপালে হাত দুটি উঠে প্রণামের মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। বিনা প্রণামে মায়ের কথা বলা ভেড়ামারার লোকেরা চিন্তাই করতে পারে না। দুর্গাপুজো হত এখানে অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে। মানতের চিনি সন্দেশের যে হাঁড়ি পড়ত তার সংখ্যানির্ণয়ে ফুরিয়ে যেত ধারাপাতে শেখা যত সংখ্যাসমষ্টি! এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত শ্রেণিবদ্ধ হাঁড়ির সারি দেখে শৈশবে বিস্ময়াবিষ্ট হতাম। সারাবছরের মানত শোধ করা হত এই পুজোর সময়। পাছে গোলমাল হয়ে যায় এই ভয়ে প্রতিটি হাঁড়ির গায়ে খড়ি দিয়ে স্পষ্টাক্ষরে নাম লেখা থাকত গৃহস্বামীদের। ছোটো গ্রামখানির বুকে পুজোর কটাদিন ধরে চলত জীবনের জোয়ার। দূর-দূরান্তরের নর-নারীরা আসত মেলা দেখতে, বিগ্রহ দর্শন করতে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। একই সঙ্গে পুজো দেখা, আত্মীয়দর্শন এবং জিনিসপত্র কেনাকাটার সুযোগ পল্লিগ্রামে বড়ো বেশি আসে, তাই-দর্শনার্থীর প্রাচুর্য চোখে লাগার মতোই হত। আজও সেইদিনকার ছবি স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। কী সুন্দর গ্রামবাসীদের হাসিখুশি মাখানো মুখগুলো, তাদের ত্বরিত চরণ ধ্বনি, বিশ্রাম ও ব্যস্ততায় হিল্লোলিত অপূর্ব জীবনছন্দ। মনে হচ্ছে যেন দেখতে পাচ্ছি মা দুর্গার সামনে করজোড়ে অঞ্জলি দেওয়ার দৃশ্য–শুনতে পাচ্ছি বৃদ্ধ পুরোহিতের উদাত্ত কণ্ঠের মন্ত্রপাঠ,
অন্ধ্যং কুষ্ঠংচ দারিদ্রং রোগং শোকংচ দারুণম।
বন্ধুস্বজনবৈরাগ্যং হরমে হরপার্বতি।
দুর্গাপুজো সমগ্র বাংলারই পুজো। সেখানে, জাতিভেদের কথা ওঠে না। পুজোর সময় সারাগ্রামে একটা জাতিই চোখে পড়ত তা হল মনুষ্যজাতি। সেইজন্যেই অঞ্জলির পর প্রসাদ গ্রহণের ব্যস্ততা দেখেছি শুধু হিন্দুদের মধ্যে নয়, মুসলমান ভাইদের মধ্যেও। অস্থিমজ্জায় এই যে একাত্মবোধ সেদিন ছিল তা কোথায় গেল আজ? সেদিন তো দেখেছি হরপার্বতী বা উমাকে নিয়ে যে গান হত তাতে উমার দুঃখে কত মুসলমান ভাই-বোনও অশ্রুবিসর্জন করেছেন।
ভুলতে পারছি না ঝুলনের সময় ঠাকুরবাড়ির যাত্রাগানের কথা। সেদিনটি যেন ছিল সমস্ত গ্রামবাসীর জীবনের একটি পরমলগ্ন। সারাবছরের প্রতীক্ষার পর আসত ওই দিনটি। আমার বয়েস ছিল অল্প, তাই উৎসাহও ছিল অনন্ত। সন্ধে না হতেই খেয়েদেয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাত্রার আসরে চলে যেতাম। জায়গা না পাওয়ার ভয়ে অভিনয়ের বহুপূর্বেই জায়গা সংগ্রহ করে উদগ্র প্রতীক্ষায় বসে থাকতাম সমস্ত ঠাট্টা-বিদ্রূপ অগ্রাহ্য করেই! ভিড় হত অসম্ভবরকম। ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাড়োয়ারিরা। গ্রামের লোক ঠাকুরবাড়িকে খুব শ্রদ্ধা করত। বাড়ির সামনে কালীঘরে কালীপুজো উপলক্ষ্যে গান বাজনার আসর বসত হামেশাই। কালীপুজোর দিন বাড়ির গুরুজনেরা আমাদের টিকিটি দেখতে পেতেন না, আমরা সবাই থাকতাম মহাব্যস্ত। বলির পাঁঠাদের তত্ত্বতল্লাশ করতাম, মহাযত্নে তাদের কাঁঠালপাতা খাওয়াতাম, তাদের কোলে করে আদর করতাম সমস্ত দিন! কিন্তু এত আদরযত্নে যাদের লালন করলাম সমস্তটা দিন ধরে সেই স্নেহের জীবটিকে মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে কোনো ব্যথাই অনুভব করিনি! মনের এই দ্বৈতপরস্পর-বিরোধিতার গুণগত ব্যাখ্যা করার বয়েস তখন না হলেও আজ খুব বিস্ময় লাগে তা ভাবতে। সেই জিনিসই কি গোটা বাংলার বুকে ঘটে গেল না?
‘নরমেধযজ্ঞ’ বা ‘নহুস উদ্ধার’ অভিনয় আমাদের একদিন সকলকেই মোহাবিষ্ট করত আজও বেশ মনে পড়ে। অভিনয়ে সুদখোর রতন দত্তের চাপে পড়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণ সিদ্ধার্থ তার শিশুপুত্র কুশধ্বজকে তুলে দিলেন রাজা যযাতির নরমেধযজ্ঞে বলি দেওয়ার জন্যে। এই দৃশ্য দেখে আমরা সেদিন জাতিধর্ম-নির্বিশেষে ডুকরে কেঁদে উঠেছি। লক্ষ করেছি আসরের আবহাওয়া মুহূর্তে পালটে গেছে শোকের গভীরতায়, কোনো দর্শকের চোখ সেদিন শুকনো ছিল না। অভিনয় সার্থক হয়ে যেন বাস্তবের রূপ পেত। আজ নহুসের কথাই বেশি করে মনে পড়ছে এইজন্যে যে তার প্রেতাত্মা কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছে শুনতে পাচ্ছি। তার উদ্ধারের জন্যে মানুষের রক্ত চাই,–সে রক্তক্ষরণ তো হল এই বিশ শতকের শেষার্ধে! এখনও কি আমার উদ্ধার আশা করা যায় না নহুসের সঙ্গে সঙ্গে? এত রক্ত কি বিফলে যাবে? আমার মনে হয়, এই যে বিচ্ছেদ আজ এসেছে তা মিলনেরই ভূমিকামাত্র। সীতা’ অভিনয়ে আমরাই তো জোরগলায় শ্রোতাদের শুনিয়েছি,
জননি আমার
হেন প্রশ্ন তুমি কর দেবী?
বাল্মীকির রাম-সীতা চির-অবিচ্ছেদ;
অন্তরে অন্তরে চিরন্তন
মিলনের প্রবাহ বহিছে।
মনে হয় এই মিলন-প্রবাহ অধুনা ক্ষীণ হলেও একদা প্রাণগঙ্গায় জোয়ার এসে সমস্ত ক্লেদ নিয়ে যাবে ভাসিয়ে। বাল্মীকি মহাকবি, তাঁর কথা মিথ্যে হতে পারে না। আমরা সে মিলনের জন্যে আগ্রহে প্রতীক্ষা করব। ‘আসিবে সে দিন আসিবে।’
হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, মাড়োয়ারি বলে আমাদের গ্রামে কোনো পার্থক্য দেখিনি। বহু মাড়োয়ারি এসে বাস করতেন ভেড়ামারায়, কিন্তু লক্ষ করেছি সবাই থাকতেন মিলেমিশে এক হয়ে। দেখেছি দু-পাঁচশো টাকা দরকার হলে চেয়ে আনত একজন অন্য আর একজনের কাছ থেকে। লেখাপড়ার কোনো দরকার হত না তার জন্যে। এই যে আত্মবিশ্বাস এর ওপরেই ছিল সেদিনকার প্রাত্যহিক জীবন। পরিশোধের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এই লেনদেনে কোনোদিন কোনো কলহবিবাদ দেখিনি আজকের মতো। এত সুবিধে-সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেউ কাউকে বড়ো একটা ঠকায়নি বা অবিশ্বাসের কোনো কাজ করেনি। পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করত, পরামর্শ দিত, পরামর্শ শুনত, পরামর্শমতো কাজও করত দ্বিধাহীনচিত্তে। সেখানে হিন্দু-মুসলমান বা মাড়োয়ারির গন্ডি টেনে জনজীবনকে কেউই সীমাবদ্ধ করত না। মাড়োয়ারি বন্ধুদের বাড়িতে প্রায়ই জুটত নিমন্ত্রণ। খাওয়াতে তাঁরা ছিলেন মুক্তপ্রাণ। বাড়িতে বেড়াতে গেলেও খাওয়ার ঘটা দেখে চোখ উঠত কপালে! তাঁদের ‘লাড়ু-মন্ডা-টিকরা’র স্বাদ এখনও ভুলতে পারিনি। সেই ঘিয়ে জবজবে খাবার এখনও জিভকে সরস করে তোলে সময় সময়! কোথায় সেদিন? কোথায় সেই মনের আত্মীয়তা? কোথায় সেই ভেড়ামারা?