জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা এলেই চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে আমার গ্রামখানি। আমার গ্রাম ভেড়ামারা আমার কাছে অতুলনীয়, বার-বার গ্রামের নাম উচ্চারণে শান্তি পাই মনে। মনের কোনো গোপন কোণে সেই ‘ভেড়ামারা” নামটি বোধহয় খোদাই হয়ে আছে, না হলে আজ এই দুঃসময়ের মধ্যেও তাকে এত নিবিড়ভাবে মনে পড়ে কেন? কেন তাহলে এই অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রামটির তুলনা খুঁজে পাই না? কেন সেই শান্তির নীড় স্নিগ্ধ সমীর’-এর কথা চিন্তা করলে চোখ জলে ভরে আসে? আজ ভেবে আশ্চর্য লাগে আমার গ্রাম আমার কাছে কেন বিদেশ হয়ে গেল একরাত্রির মধ্যে? প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা গ্রামখানি কেন হঠাৎ লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেল?
আমার গ্রাম পূর্বে ছিল নদিয়া জেলায়, আজ হয়েছে কুষ্টিয়া জেলার কুক্ষিগত। আগে এই কুষ্টিয়াও ছিল নদিয়া জেলারই একটি মহকুমা। এককালে একটি ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল আমার গ্রাম। কলকাতার পণ্যের বাজারে তাই ভেড়ামারার একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল বাঁধা। একদিন এখান থেকেই পাট আর পান রপ্তানি হত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে রেল ওয়াগন ভরতি হয়ে। ইলিশ মাছও বাদ যেত না সে তালিকা থেকে। মাইল তিন চার উত্তরে পদ্মা নদীর ধারে ‘রাইটা’ থেকে বরফ দিয়ে মাছের সেরা ইলিশ মাছ আসত ভেড়ামারা স্টেশনে বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হওয়ার জন্যে। বৃদ্ধদের মুখে শুনেছি একদা এখানে নাকি বাইশ তেইশটি ইলিশ মাছ মিলত একটাকায়। কুটুম্ববাড়ি যেতে হলে তাঁরা একটাকার ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যেতেন মুটের মাথায় চাপিয়ে! সেই মাছ অবশ্যি শুধু কুটুম্বরাই খেতেন না, আশপাশের আরও অনেকেই রসাস্বাদন করতেন তার। আমরা অতটা না দেখলেও তার খানিকটা আভাস পেয়েছি। খাদ্যদ্রব্য খুব সস্তাই ছিল এখানে, আজ আর অবশ্যি সেদিন নেই। এখন সব কিছুই অগ্নিমূল্য। এখন মাছ থাকলে তেল থাকে না, তেল থাকলে মাছের অভাব ঘটে। সেদিনের রাম যখন নেই, তখন অযোধ্যার অন্বেষণ করা বৃথা। কেন হল এই দৈন্য? গরিব মানুষের কি সুবিধে হয়েছে দেশ-দ্বিখন্ডিত হয়ে? দেশমাতার অঙ্গচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষেরও যে অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে সে-কথা মোটেই আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। আগেকার কথা ভেবে তাই অস্থির হয়ে পড়ি সময় সময়, কিন্তু আমার অস্থিরতার মূল্যই বা কী? চেষ্টা করলে পারি না কি আবার আমরা এক হতে? পারি না কি দেশের বুকের ওপর যে শ্বাসরোধক প্রাচীরটা তোলা হয়েছে তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে পারি নাকি আবার আমরা পরস্পরকে বিশ্বাসভরে আলিঙ্গন করতে? কাকে ছেড়ে কার চলবে? তবে কেন সমস্ত মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সাম্প্রদায়িক দৈত্যের দাসত্ব করব জীবনভোর?
গ্রামে বাস করার কোনো অসুবিধেই ছিল না। সরকারি হাসপাতাল, হাই স্কুল, থানা, স্টেশন, নদী ইত্যাদি কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। আশ্বিন-কার্তিক মাসে গ্রামখানিতে যেন লক্ষ্মীশ্ৰী ফুটে উঠত। সব দিকে ব্যস্ততা। সে সময় এত পাট আমদানি হত যে পাটের কাঁচা গন্ধে বাতাস হয়ে উঠত ভারী। একমাত্র পাটকে কেন্দ্র করেই লক্ষ লক্ষ টাকার আদান-প্রদান চলত প্রতিদিন। কলে পাট চাপানো হত–সেই সময়ে কুলিদের সমস্বরে গাওয়া খুশিভরা বিচিত্র ‘হো-আই-লো’ গানের সব টুকরো টুকরো কলি আজও সময় সময় কানে এসে বাজে যেন। অন্য সময় চাল-ধান, ছোলা-মটর আর পানের ফলাও কারবারে ব্যাবসায়ীরা থাকতেন ব্যতিব্যস্ত। লক্ষ্মীর ধ্যানে সকলেই থাকতেন মশগুল, অন্য দিকে মন দেওয়ার তেমন অবসরই থাকত না কারও। দুঃখ হয় সেদিনের কথা ভেবে, কোথায় গেল সেই মধুর দিনগুলো।
মনে পড়ে পুণ্যাহে’র সময় জমিদারের কাছারিতে সে কী খাওয়া-দাওয়ার ঘটা! আকণ্ঠ চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয়ের পর বাড়ি ফিরতাম শোলার একটা মালা গলায় দিয়ে। এই ‘পুণ্যের আসরে কোনোদিন জাতিভেদ দেখিনি। হিন্দু প্রজা মুসলমান প্রজা সমান উৎসাহের সঙ্গেই জমিদার বাড়িতে খেয়ে এসেছে, গল্পগুজবে মশগুল হয়ে একই সঙ্গে ফিরে এসেছে আপন আপন বাড়িতে। জানি না হঠাৎ সেই মধুর সম্পর্কের মধ্যে কী করে ফাটল ধরল, ‘পুণ্যের মধুর বন্ধনে পাপের প্রবেশ ঘটল কখন কী করে!
আমাদের বাড়ির সামনেই বসত হাট। সপ্তাহে দু-দিন। মনিহারি, জামা-কাপড় থেকে শুরু করে মাটির হাঁড়ি, কলসি, মশলা, প্রায় সব কিছুই পাওয়া যেত হাটে। তরিতরকারি এবং মাছ-মাংস তো বটেই। গ্রামের হাটের সঙ্গে কোথায় যেন একটা বিরাট পার্থক্য আছে শহুরে বাজারের। হাটের সঙ্গে গ্রামের অতিসাধারণ মানুষেরও একটা সুনিবিড় সম্পর্ক আছে। তেমন সম্পর্কের কোনো হদিশ মেলে না শহুরে বাজারে। আমাদের গ্রাম্য হাটটি তাই ছিল একাধারে মিলনক্ষেত্র এবং শিক্ষাক্ষেত্র। সপ্তাহে দু-দিন কেনাকাটা করতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দূরগ্রামের লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও হয়ে যেত হাটে। আমরা জিনিস কেনার জন্যে যত না হাটে। গেছি তার চেয়ে বেশি গেছি বন্ধুজন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চাক্ষুষ আলাপের জন্যে। এই যে আমাদের গ্রামকেন্দ্রিক আত্মীয়তাপূর্ণ মন তা বিনষ্ট হল কেন? সেই সুন্দর পল্লিজীবন, সেই গোচারণ ক্ষেত্র, সেই মর্মরধ্বনি মুখরিত বেণুকুঞ্জ কোন পাপে আমাদের জীবন থেকে নির্বাসিত হল কে জানে! পল্লিজীবনের সুস্নিগ্ধতা, সরলতা আর বনপ্রান্তরের সৌন্দর্য ও পাখির কাকলি দিয়ে যে জীবন ছিল ঘেরা সে জীবন কি আবার ফিরে পেতে পারি না? পল্লিগ্রামগুলো বাঙালির জাতীয়জীবনের মূল আশা এবং আশ্রয়স্থল। সেই পল্লি থেকেই আমরা হলাম বিচ্যুত! কিন্তু আমাদের কী দোষ?