‘তা কয়েকদিন আছেন তো? কাইল আমার খাজুর গাছ নাগাইছি। আপনার জন্যে এক হাড়ি রস দিবার মন করি।’–কোথা থেকে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে জব্বর। কাছারির গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান জব্বর মুনশি। ওর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখলেই জোর করে নিয়ে যাবে বাড়িতে। কিছু না খাইয়ে কিছুতেই আসতে দেবে না। এমন মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সবার সঙ্গে।
বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে। খোরশেদপুর এম. ই. স্কুল। এই স্কুলেই বিদ্যা শিক্ষার হাতেখড়ি আমার। খোরশেদপুরের স্কুলজীবনে মাত্র তিনদিন স্কুল পালিয়েছিলাম। বড়ো রাস্তা ছাড়া একটা জঙ্গলের পথেও স্কুলে যাওয়া যেত। এই জঙ্গল সম্পর্কে নানারকম জনশ্রুতি রয়েছে। ভূতের জঙ্গল বলে ছিল এর পরিচয়। বলা বাহুল্য কোনোদিন ভূত কিংবা ভূতের বাসস্থানের আমরা সাক্ষাৎ পাইনি। স্কুল পালিয়ে খেত থেকে মটরশুটি চুরি করে এনে বনের ভেতর গাছতলায় বসে বসে খেতাম। একদিন ধরা পড়ে যাওয়ার পর আর স্কুল পালাইনি। মাঝে মাঝে আবার শিকারে বের হতাম। কোনোদিন নদীর ধারে খরগোশ শিকারের আশায়, কোনোদিন দক্ষিণ দিকের জঙ্গলে বাঘের বাচ্চা ধরবার উদ্দেশ্যে মহড়ায় বের হতাম। কিন্তু কোনোদিন একটা ফড়িংও ধরতে পারিনি। এমনই সব অদ্ভুত খেয়ালে পাঠ্যজীবনটা কাটিয়েছি বেশ। একবার দেবুর আর আমার মাথায় খেয়াল চাপল যে ডাকাতি করে গরিবদের দান করতে হবে। যে কথা সেই কাজ। খেলার ছোটো পিস্তলটি নিয়ে রাত দশটার সময় বাইরের ঘর থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম আমি আর লেফটেন্যান্ট দেব। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারিনি। পাশের বাড়িতেই প্রথম মহড়া দিতে গিয়ে কী যে নাকাল হয়েছিলাম সে করুণ কাহিনি প্রকাশ না করাই ভালো। অবশ্যি এমন সব বুদ্ধি হত ডিটেকটিভ বইয়ের নানা আজগুবি গল্প পড়ে।
কিশোরজীবনের এই রূপকথার রাজ্যে মূর্তিমান বাস্তব ছিলেন গফুর মাস্টার। আমার জন্মের পূর্ব থেকেই গফুর মাস্টার আমাদের গৃহশিক্ষক। দাদা-দিদিদের হাতেখড়ি দিয়েছেন তিনিই। কলকাতায় এসে অনেক কৃতবিদ্য শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করে ধন্য হয়েছি, কিন্তু কোনোদিন গফুর মাস্টারকে ভুলতে পারিনি। কলকাতার পথে চলতে চলতে রেডিয়োতে একটা গান শুনলাম : নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। গানটা শুনে আমার মন চলে গেল অনেক দূরের স্মৃতির রাজ্যে শিলাইদার এক প্রান্তে, কোন এক মুগ্ধ কিশোরমনের চিত্র সেটি। ঢল নেমেছে পদ্মার দু-তীরে। সারাটা আকাশে কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। পুবদিকের জানলাটা খোলা। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথ এমন দিনেই হয়তো এখানকার পদ্মার বোটে ‘সোনার তরী’ আর ‘খেয়া’র কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন। সেদিনও আকাশ হয়তো এমন মেঘাবৃত ছিল। সেই মেঘমেদুর অম্বরের প্রান্তঘেঁষা তাল-তমাল বন লক্ষ করে একদিন, সে বহুদিন আগে, আরও একজন কবি ‘শতক যুগের গীতিকা’য় সুর সংযোজন করেছিলেন। মন তখন অতীতমুখর। শুনতে পেলাম পদ্মানদীর মাঝি সুর ধরেছে : ‘কুল নাই, কিনারা নাই, নাইকো গাঙের পাড়ি, সাবধানেতে চালাইও মাঝি আমার ভাঙা তরি। সে দিন আর বুঝি ফিরে আসবে না!
রবিবার আর বুধবার এই দু-দিন বাজার বসত গ্রামে। বাকি পাঁচদিন গোপীনাথ দেবের মন্দিরের সামনে বসত বাজার। বাজারের পাশ দিয়েই পদ্মা প্রবাহিতা। চৈত্র-বৈশাখ মাসের পদ্মা আর বর্ষাকালের পদ্মা যেন আকাশপাতাল তফাত। পদ্মার এই দুটো রূপকেই আমি ভালোবাসি। দারুণ গ্রীষ্মের দাবদাহে পদ্মা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আবার বর্ষার কালোমেঘ দেখলেই পদ্মা যেন উন্মাদের ন্যায় উত্তাল তরঙ্গ ভেঙে দুর্বার হয়ে ওঠে।
এই আমার শিলাইদা। আজ তার পরিচয় দিতে গিয়ে কেবলই মনে হচ্ছে শিলাইদহে জন্মগ্রহণ করে আমি ধন্য হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ এই শিলাইদহকে খুব ভালোবাসতেন। এখানকার কুঠিবাড়িটি ছিল তাঁর নিজস্ব। এখানে থাকতেই তিনি ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদে হাত দেন। এখান থেকে কিছু দূরেই স্বৰ্গত সাহিত্যসেবী জলধর সেনের বাড়ি কুমারখালি। সব স্মৃতির বন্ধনই অটুট আছে, কেবল দেশের ব্যবধান গেছে বেড়ে। তবুও আমি শিলাইদহকে ভুলতে পারি না। মনে হয় আবার আমার গ্রামকে ফিরে পাব, ফিরে পাব গফুর মাস্টার, জব্বর মুনশি, সবাইকে।
.
ভেড়ামারা
পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে।।
এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি;
সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে।।
কবিগুরুর গানটি আজ আমাদের মনের কথা ব্যক্ত করছে। পথের ডাককে অগ্রাহ্য করতে না পেরে আজ আমরা মৃত্যুর পথে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছি অন্ধকার নিশিতে। অপটু-চরম ক্লান্তিতে পড়েছে ভেঙে, পথরেখা মুছে গেছে সম্মুখ থেকে, ফলে জীবনযাত্রায় আমরা পড়েছি পিছিয়ে–এ সময় এমন একটি ধ্রুবতারারও সন্ধান পাচ্ছি না যার আলোর নির্দেশে আমরা এগিয়ে গিয়ে নির্বিঘ্নে জীবনে হব সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়েছি দূরে। শস্যশ্যামলা গ্রাম্য পরিবেশ ছেড়ে রুক্ষ শহুরে আবহাওয়ায় যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ললাটে জন্মভূমির কোমল স্পর্শের জয়তিলক নিয়ে জন্মের প্রথম শুভক্ষণে কান্নার সুরে ‘মা-মা’ বলে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলাম একদিন আজ জীবন-মধ্যাহ্নে কাঁদতে কাঁদতে আবার আশ্রয় প্রার্থনা করছি দেশজননীর কাছে। সেদিন পেয়েছিলাম গ্রাম-জননীর কোল, আজ তাঁর কাছ থেকে বিতাড়িত। সেদিন আর এদিনের মধ্যে পার্থক্য অনেক, আজ আমার চলার পথে কাঁটা, শ্বাস প্রশ্বাসে নাগিনির সুতীক্ষ বিষ! দ্বীপান্তরিত লাঞ্ছিত জীবন নিয়ে সর্বদাই বিব্রত। কেবল নিজের চিন্তায় সব সময় বিভোর। তবু মন পড়ে আছে সেই সুদূরে হারানো মায়ের কোলে, পল্লির ছোট্ট কুটিরে, আমার গাঁয়ের শ্যামঘন-নীলাকাশে। সেসব দিনকে আজ দিকচক্রবালে স্বপ্নের মতো মনে হয়। জানি না দেশজননী আবার মা-জননীর মতো কোলে ঠাঁই দেবেন কি না, আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পাব কি না!