অমাবস্যার আকাশে পূর্ণচন্দ্র! এও কি সম্ভব? সম্ভব নাকি হয়েছিল এরূপ জনশ্রুতি রয়েছে। অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছিলেন আমাদেরই প্রতিবেশী ত্রিপুরা জেলার মেহের কালীবাড়ির সুপ্রসিদ্ধ সাধক সর্বানন্দ ঠাকুর আর আমাদের গুরুবংশের আদিপুরুষ ‘ত্রিশূলী’মশাই। ত্রিশূলী-র কালী’ আজও নাকি পুজো পান আমার গাঁয়ের মানুষের কাছে। কিন্তু পাপশক্তির বিনাশে মায়ের খঙ্গ তো আর নেচে ওঠে না! ‘ত্রিশূলী’-র বংশধরেরা তাই বুঝি আজ ত্রিপুরা রাজ্যে পলাতক!
ছোট্ট গ্রাম রামচন্দ্রপুরের অধিকাংশ জমির মালিকই ছোটো ছোটো জমিদার আর তালুকদার। তাঁদের মধ্যে হিন্দুও আছেন, মুসলমানও আছেন। গ্রামের মধ্যে বিশেষ করে তাঁরাই সম্পন্ন, তাঁরাই শিক্ষিত এবং তাঁদেরই অর্থে ও চেষ্টায় গড়ে উঠেছে পল্লির ছেলে মেয়েদের বিদ্যায়তন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডাকঘর, ক্লাব ইত্যাদি। তবে শিক্ষাদীক্ষায় স্থানীয়
হিন্দুরাই বেশি উন্নত এবং এগ্রামের প্রতিষ্ঠাতাও কায়স্থ ভূস্বামীরাই। আর সব জায়গার মতো আমাদের গ্রামেও ঝগড়াবিবাদ ছিল। লড়াই ও লাঠালাঠির কথা শুনেছি, দেখেছিও। কিন্তু সেসবই ছিল জমিদারির লড়াই। সেসব লড়াই আর লাঠালাঠি তালুকদারে তালুকদারে হয়েছে–হিন্দু-মুসলমানের কথা তাতে কোনোদিন ওঠেনি। হয়তো কোনো ধান খেতে একটা আল নিয়ে ঝগড়া বেধেছে একজন হিন্দু আর একজন মুসলমান তালুকদারের মধ্যে। দেখা গেল বাকি কয়জন মুসলমান তালুকদারই যোগ দিয়েছেন হিন্দু তালুকদারের পক্ষে, আবার কয়েকজন হিন্দু ভূস্বামী সাহায্য করছেন তাঁদের বিবাদমান মুসলমান প্রতিবেশীকে। এমন ঘটনা অনেকবারই নাকি ঘটেছে আমাদের গাঁয়ে এবং পাশাপাশি এলাকায়।
সাধারণ হিন্দু-মুসলমান একে অন্যকে সাহায্য করেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির বছরেও এমন ঘটনা খুঁজে বেড়াতে হত না। কিছুকাল আগের কথা। সম্ভ্রান্ত তালুকদার উজির আলি ভাগ্য বিপর্যয়ে অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। বাবার চেয়ে বয়েসে কিছু ছোটো হলেও একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে। উজির আলি সাহেবকে ডেকে পাঠালেন বাবা। তিনি এলেন এবং বন্ধুর মতোই বাবা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘উজির, শুনছি পারিবারিক মর্যাদা বজায় রেখে সংসার চালানোই নাকি তোমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তার জন্যে চিন্তা কোরো না ভাই।’ এই বলে বাবা বিনে খাজনায় ভোগস্বত্ব দিয়ে বারো বিঘের একটা ধানজমি লিখে দিলেন উজির আলি সাহেবকে।
স্বাধীনতার সংগ্রামী হিসেবে বিদেশি শাসক আর তার পদলেহীদের হাতে লাঞ্ছনা সয়েছি দীর্ঘকাল ধরে; কিন্তু মনে আনন্দের ভাটা পড়েনি তাতে কোনোদিন। বরং ওদের বাঁধান যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন ঠুটবে মোদের ততই বাঁধন টুটবে।”- মহাজনের এই মহাবাণী লক্ষ্যসাধনে আমাদের মনোবলকে চতুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শত নির্যাতনের মধ্যেও দেশবাসীর অপার স্নেহ ও প্রীতি আমাদের কৃতজ্ঞতায় ভারাক্রান্ত। সেই দেশবাসীর একাংশ বিষের বাঁশি বাজিয়ে আমাদের করল ঘরছাড়া।