খোকন একবার বলেছিল, টম আর মিনিকে সঙ্গে করে নিয়ে চলো না বাবা! খোকনের মাও সায় দিয়েছিলেন তাতে। আমার মনে প্রশ্ন জাগল; ওরা কী দোষ করেছে? ওদের কেন অকারণে দেশছাড়া ভিটেছাড়া করব? রাজনীতির পঙ্কিলতায় ওরা তো মাথা গলায়নি!
কিন্তু তাতে কী? মানুষেরই প্রতিপালিত জীব ওরা, মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ওদেরও কিছুটা করতেই হবে। তাই আমাদেরই পাপে দেশবিভাগের সম্মতির পরিণামে পরিজনহীন কত টম কত মিনি যে বেদনা-বিহ্বল হয়ে দিন কাটাচ্ছে আজ, কে তার হিসেব রাখে?
আচ্ছা, আমাদের টম, আমাদের মিনি এখনও কি আমাদেরই বাড়িতে আছে? টম কি আজও শুয়ে থাকে টেকিঘরের বারান্দায় তারই গড়া গর্তটার মধ্যে? অপরিচিতের পদশব্দে আজও কি টম তেমনই গর্জে ওঠে প্রহরীর কর্তব্য পালন করতে? ইঁদুর, পোকামাকড় এমনকী সাপ দেখেও মিনি কি এখনও তেমনই তেড়ে যায়? ওরা হয়তো আজও খুঁজে বেড়ায় খোকনকে এঘরে-ওঘরে, বাড়ির উঠোনের পেছনে, আর তার সঙ্গ না পেয়ে, আমাদের কাউকে না দেখে হয়তো ডুকরে কাঁদে!
আর আমাদের মুসলমান প্রতিবেশীরা? যুগ যুগ ধরে পারস্পরিক সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে যাদের সঙ্গে পাশাপাশি বাস করেছি, তারা একটুও কি দুঃখবোধ করল না আমাদের ছেড়ে দিতে? ওরা দাদা ডেকেছে, মামা ডেকেছে, আমরাও ওদের কাউকে ডেকেছি চাচা, আবার কাউকে ডেকেছি নানা। রাজনীতির খাঁড়ার কোপে যুগ-যুগান্তের সেই আত্মীয়দের সম্পর্কে কি চিরতরে ছেদ পড়ে গেল? ওদের কারও কারও মনের মণিকোঠায় হয়তো আজও আমাদের কথা জাগে। কিন্তু ওদের সঙ্গে প্রতিবেশীরূপে আর কি কোনোদিন দেখা হবে না?
গ্রাম ছেড়ে আসার দিনই অসময়ে একটা কাক ডেকে গিয়েছিল আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে। সে-ডাকে শুনেছিলাম কান্নার সুর। কাকের কণ্ঠ মনে রাখার মতো নয়। তবু কেন পল্লিমায়ের কোল-ছাড়া হয়ে আসার একটু আগে শোনা শেষ কাক-স্বর আজও কানে বাজে!
নিতান্ত গন্ডগ্রাম হলেও শ্রীভূমি শ্রীহট্টে একটা গৌরবময় স্থান অধিকার করে রয়েছে আমার সাধের গ্রাম রামচন্দ্রপুর আর তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। ক্ষুদ্র নবদ্বীপ বলে পরিচিত যে পঞ্চখন্ড, সংস্কৃত শিক্ষার অন্যতম সেই কেন্দ্রভূমিরই একাংশ আমাদের গ্রাম। মোট আট-দশ হাজার অধিবাসীর মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয় ভারতীয় শিক্ষিতের গড়পড়তা হারের তুলনায়। তাঁরা প্রত্যেকেই গর্ব করে এসেছেন এতকাল এই বলে যে, এমন এক ঐতিহাসিক গ্রামে তাঁদের বাস যার অন্তত হাজার বছরের প্রাচীনত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে তাঁদের সামনে।
কুমার ভাস্কর বর্মার তাম্রশাসনের কথা বলছি। কামরূপের রাজা ছিলেন কুমার ভাস্কর বর্মা। থানেশ্বরের অধীশ্বর দানশীল হর্ষবর্ধন শিলাদিত্যের তিনি ছিলেন সমসাময়িক। আমাদের গ্রাম থেকে মাত্র দু-মাইল দূরে আবিষ্কৃত হয়েছে ভাস্কর বর্মার তাম্রশাসন। সেই তাম্রশাসনে বর্ণিত কুশারী নদী আজও বয়ে চলে আমাদেরই গ্রামের পাশ দিয়ে। গাঙ্গুলি ও চন্দ্রগ্রামের ইতিকথা কিছু না জানা থাকলেও তাম্রশাসনের উল্লেখ থেকে আমাদের অঞ্চলবর্তী এ দুটি গ্রামের প্রাচীনত্ব ধারণা করা যেতে পারে।
শুধু কি এই? কত স্মরণীয় কত বরণীয়ের আবির্ভাব ঘটেছে আমাদের এ অঞ্চলে। পাশের গ্রাম দিঘিরপারে জন্মেছিলেন সুবিখ্যাত নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি। ছেলেবেলায় পড়েছি রঘুনাথের ছোটোবেলার কথা। কী অপরিসীম বুদ্ধি ছিল তাঁর অতটুকু বয়সে! পরবর্তীকালে যাঁর প্রতিভার দীপ্তি সারাভারতকে প্রদীপ্ত করেছিল, তিনি ছিলেন আমারই পূর্বপুরুষের প্রতিবেশী, বন্ধুজন হয়তো–একথা ভাবতেও শিহরন অনুভব করি। সেকালে ছিল না বৈদ্যুতিক আলো, ছিল না দেশলাই। আগুন ধরানো হত চকমকির সাহায্যে। তাও গরিবের পক্ষে ছিল দুর্লভ। পাঁচ বছরের শিশু রঘুনাথকে তাঁর মা বলেছিলেন একটু আগুন নিয়ে আসতে উনুন ধরাবার জন্যে। রঘুনাথ পাশের বাড়ির গিন্নির কাছে গিয়ে চাইলেন একটু আগুন। গিন্নি জিজ্ঞেস করলেন আগুন নেবার পাত্র কোথায়? রঘুনাথ তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলেন রান্নাঘরের পাশেই এক ছাইয়ের স্তূপ। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দু-হাত ভরে ছাই তুলে নিয়ে আবার গেলেন প্রতিবেশী গিন্নিমায়ের কাছে। গিন্নিমা বিস্মিত হয়ে একবার চাইলেন তাঁর দিকে, তারপর একহাতা আগুন তুলে দিলেন হাতের ওপরকার সেই ছাইয়ের ওপর। রঘুনাথ হাসতে হাসতে এগিয়ে চললেন তাঁদের বাড়ির দিকে। সম্মুখেই টোল। পন্ডিতমশাইয়ের চোখে পড়ল এই বিস্ময়কর ব্যাপার? রঘুনাথকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করে শুনলেন সব কথা। সব দেখেশুনে তাঁর মায়েরও বিস্ময়ের অবধি রইল না। নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলে রঘুনাথ। ছেলেকে টোলে পড়াবার সাধ থাকলেও বাপ-মায়ের সে সাধ্য ছিল না। কিন্তু সেদিনকার সে-ঘটনায় বিমোহিত পন্ডিতমশাই রঘুনাথকে নিজে ডেকে নিয়ে বিনে পয়সায় তাঁর টোলে পড়াতে লাগলেন। সেই কবে পড়েছি এই গল্প, আজও ভুলিনি। ভোলা যে যায় না।
শ্রীচৈতন্যের জন্মপূত ঢাকা-দক্ষিণ সারাভারতের তীর্থক্ষেত্র। মাত্র সাত মাইলের পথ সে গ্রাম আমাদের বাড়ি থেকে। শ্ৰীমনমহাপ্রভুর বাড়িতে যথারীতি পূজার্চনা চলছে শুনে এসেছি। নিত্য কীর্তনের ব্যবস্থাও নাকি এখনও অব্যাহত আছে। চৈতন্যদেবের জ্ঞাতি বংশের লোকেরা আজও সেখানে রয়েছেন। কতদিন থাকতে পারবেন তাঁরা জানি না। তবে প্রেমময় শ্রীগৌরাঙ্গের সংকীর্তনে নবদ্বীপের পথে পথে একদিন যেমন ভক্তিরসে মেতে উঠেছিল হিন্দু মুসলমান একযোগে, ক্ষুদ্র নবদ্বীপ’ পঞ্চখন্ডে তেমন দিন দেখা দেবে সে-আশা নিতান্তই দুরাশা। এ যুগে যবন হরিদাসের আবির্ভাব একান্তই যেন অসম্ভব, ব্রাহ্মণ কালাপাহাড়েরই ছড়াছড়ি চারদিকে। তাই তো দেশেমাতৃকার দেহ-খন্ডন, তাই তো আজকের এই সর্বনাশ এই হাহাকার।