সেদিন আর আজ। দুস্তর সমুদ্রের ব্যবধান। রাজনৈতিক পঙ্কিলতায় ডুবে আজ মানুষের মন বিষাক্ত, হিংস্রতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু চিরকালই কি এমন ছিল? হিন্দুর বহু ধর্মীয় উৎসবে যোগদান করেছে মুসলমান। আমাদের বারোয়ারি কালীপুজোয় যে শখের যাত্রা হত, তাতে বহু মুসলমানকে দেখেছি ছড়ি হাতে নিয়ে অশান্ত জনতাকে শান্ত করতে। আর প্রতিবছর মহরমের দিন গাজনতলায় যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হত, তাতে নিজ গ্রামের খেলোয়াড়দের অপূর্ব ক্রীড়ানৈপুণ্যে আমার বুকও কি গর্বে দশ হাত উঁচু হয়ে উঠেনি! সেসব তো আজ অতীতের বিস্মৃতপ্রায় স্বল্পকাহিনি!
আগে গ্রামে বিদ্যাচর্চার খুবই সুযোগসুবিধা ছিল। তর্করত্নমশাইদের চতুষ্পঠীতে বহুদূরদেশ থেকে লোক বিদ্যার্জন করতে আসত। আজ আর তার চিহ্ন নেই। ছিল ভাঙা আটচালায় গুটিকয় ছাত্র নিয়ে অপুর পাঠশালা। সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। সবই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। শুধু বাইরে নয়, অন্তরেও চিড় ধরেছিল বহুদিন থেকেই। শ্রীহট্টে গণভোটের সময় চিরশান্ত রসিদ, যাকে শ্রদ্ধা করতাম, গ্রাম্য সম্পর্কে চাচা বলে সম্বোধন করতাম তার কথাবার্তায় পর্যন্ত উন্মা ও অবর্ণনীয় ক্রোধ প্রকাশ পেয়েছে দেখে বিস্মিত হয়েছি, দুঃখ পেয়েছি। মর্মান্তিক দুঃখে বিষণ্ণ বোধ করেছি রানিদির কথা ভেবে। লক্ষ্মীর প্রতিমার মতো রূপ। স্নেহমধুর ব্যবহার। বিয়ের কিছুদিন পরই বিধবা হয়ে অবাঞ্ছিতরূপে ফিরে এসেছিলেন বাপ-ভাইয়ের সংসারে। তবু আমাদের জন্যে তাঁর স্নেহধারায় কার্পণ্য হয়নি কোনোদিন। আজ শ্রীকান্তের মতোই বলতে ইচ্ছে করে, বাংলার পথে-ঘাটে মা-বোন। সাধ্য কি এঁদের স্নেহ এড়িয়ে যাই। সেদিন কলকাতার মেসে এক রুদ্ধ কোঠায় আঝোরে অশ্রুপাত করে ডেকেছি রানিদিকে।
গ্রামের কথা বলতে বলতে গ্রামের যত সব সোনার মানুষেরই ভিড় জমে ওঠে মনে। যদি এতে ইতিহাস না থাকে, চিত্র না থাকে, আমি নিরুপায়। আমার কাছে এদের প্রত্যেকেই অপরিহার্যরূপে আজও চিরঅমলিন। আমার পঞ্চখন্ডকে আমি ফিরে পেতে চাই, ফিরে পেতে চাই আমার আপনজনকে। হয়তো পাব। ইতিহাস তো আগে থেকে কোনো কথা বলে না।
.
রামচন্দ্রপুর
‘স্বদেশ স্বদেশ করিস কেন, এদেশ তোদের নয়’–চারণ-কবির এই গান আমরা সমবেত কণ্ঠে গেয়েছি ছোটোবেলায় আমাদের সোনার গ্রামের পথে পথে। গ্রামের মেয়ে-বধূ আর শিশু-বৃদ্ধের দল সার বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছে পথের দু-ধারে, স্বেচ্ছাসেবক দলের গানে তারাও অভিভূত হয়েছে। এক এক সময় তাদের চোখে দেখেছি জল, মুখময় যেন কী বেদনা! পরদেশি শাসনের তীব্র জ্বালা। কিন্তু আজ! ব্রিটিশ শাসনমুক্ত দেশের মাটিতেও আজ আমার অধিকার নেই! পিতৃপুরুষের যে ভিটেকে মায়ের মতো ভালোবেসেছি, যে মাটিকে প্রণাম করে বিদেশি শাসকের রোষবহ্নিকে বরণ করে নিয়েছিলাম, স্বপ্নময় কৈশোরে আমার জন্মভূমি জননীকে একদিন নবারুণালোকে স্বাধীনতার স্বর্ণ সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত দেখব আশায়, সেই মাটিই যেন আজ বিরূপ! স্নেহময়ী সেই মাটির মায়ের কোথায় সেই অভয়া রূপ? তার কোল-ছাড়া ভিটে-ছাড়া হয়ে আজ ছিন্ন-ভিন্ন আমরা। কোথায় মায়ের অভয় আহ্বান? কবির গানই কি তবে সত্যি–স্বদেশ মোদের নয়, দেশের মাটিতে নেই আমাদের কোনো অধিকার? মাতৃপূজার এই কি পুরস্কার?
মনে পড়ে স্বদেশি যুগের কথা। কবিগুরুর রাখিবন্ধনের গান গেয়েই আমরা ক্ষান্ত হইনি, মনেপ্রাণে রূপায়িত করেছি কবির বাণী ও প্রেরণাকে। কে হিন্দু, কে মুসলমান এ প্রশ্ন বড়ো করে কোনোদিনই আমাদের মনে আসেনি। ভাই ভাই হয়েই আমরা কাজ করেছি পল্লি উন্নয়নে, দেশ ও দেশবাসীর সেবায়।
আমার প্রতিবেশী মুসলমান বন্ধু যেদিন গাঁয়ের মাটি ছেড়ে দূরপথের যাত্রী হল অর্থান্বেষণে সে-দিন তাকে বিদায় দিতে যে বেদনা বোধ করেছিলাম সে তো আত্মীয়-বিরহেরই ব্যথা। সেই দূরবাসী বন্ধুর পথের আশায় ডাকঘরে যেয়ে যেয়ে আমার কৈশোর-জীবনের কতদিন যে হতাশায় ভরে উঠেছে আজও মনে জাগে তার বেদনাময় স্মৃতি, আবার এক একদিন তার পত্র হাতে নিয়ে যে কত উৎফুল্ল হয়ে বাড়ি ফিরেছি সে-কথাও ভুলে যাইনি। কিন্তু কোথায় আজ সেই বন্ধু? আজ আমি যখন ছন্নছাড়া শরণার্থীর বেশে কলকাতার জনারণ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি, আমার সেই প্রাণের বন্ধু আমার কথা কি মুহূর্তের জন্যেও ভাবছে? সাতপুরুষের ভিটেমাটি পুণ্য জন্মভূমি ছেড়ে আমরা যেদিন মান-প্রাণের দায়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশ যাত্রায় সে-দিন তো বন্ধু এসে বাধা দিল না বা আর কোনো মুসলমান প্রতিবেশী এসে বারণ করল না চলে আসতে গ্রাম ছেড়ে!
টম যেন বুঝতে পেরেছিল দু-দিন আগেই যে, আমরা চলে যাচ্ছি কোথায় কোন অজানা দেশে। আসার আগের দিন সারারাত ধরে টমের সে কী কান্না! রওনা হবার দিন সকালবেলাও খোকন মুঠো মুঠো ভাত দিয়েছে টমকে, কিন্তু টম শুধু তার ল্যাজ নেড়ে খোকনের গা ঘেঁষে এসে কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে ভাতে আর মুখ দেয়নি।
মিনি বেড়ালটাও পিছু নিয়েছিল ক-দিন ধরে। বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলোর কতই না প্রিয় সে। শেষ দু-দিন দেখেছি আমাকেই আটকে দেবার জন্যে সে যেন একটা প্ল্যান করেছিল। তা na হলে কোনোদিন সে যা করেনি তা করবে কেন? চলে আসার আগের পরপর দু-রাত মিনি আমার বিছানায় ঠিক আমার পায়ের তলায় শুয়ে কাটিয়েছে। ঘুমের আবেশে তার মিনতিভরা স্পর্শও যেন অনুভব করেছি। সকাল বেলা জেগে উঠে লক্ষ করেছি তার সকরুণ বিমর্ষতা!