বাংলার পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত শ্রীভূমি। মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের পদধূলি লাঞ্ছিত, অদ্বৈতাচার্য ও দেশনায়ক বিপিন পালের জন্মস্থান পবিত্র শ্রীভূমি। তারই কোলে সদা উজ্জ্বল আমার গ্রাম পঞ্চখন্ড। বাংলার হাজার গ্রামের মধ্যে আমার গ্রাম অনন্যা। অদূরে উত্তাল প্রবহমান নদ ব্রহ্মপুত্র, তার শাখানদী কুশিয়ারা। বৈষ্ণবতীর্থ পঞ্চখন্ড, পার্শ্ববর্তী গ্রাম ঢাকা-দক্ষিণ। অতীতে বাংলা ও বাংলার বাইরে থেকে সমাগত বিদ্যার্থী পুণ্যার্থীদের চরণস্পর্শে ধন্য হয়ে যেত এই গ্রাম। যাঁরা আসতেন, তাঁরাও এ গ্রামের সান্নিধ্যে এসে নতুন প্রেরণা অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করে নিয়ে যেতেন। মহাপ্রভূর বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষায়, জ্ঞানে-গরিমায় পুণ্যব্রতা এই গ্রাম।
তার কথা বলতে গিয়ে মন চলে যায় অতীতে, অনেক দূরের অতীতে। মনের অলিতে গলিতে এলোমেলো ভাবনার ভিড়। তন্ময়তায় একেবারে ডুবে যাই। হঠাৎ যেন একটানা বাঁশির শব্দে চমকে উঠি। ওপার থেকে যাত্রী নিয়ে স্টিমার ছাড়ল। আমিনগাঁও রেল কোম্পানির বিজলি বাতি ঝিকমিক করছে এপার থেকে। নদ ব্রহ্মপুত্র। নিস্তরঙ্গ জলরাশি। একখানি শূন্য নৌকা ধীরে ধীরে ভিড়ছে পারে। কয়েক বছর আগে কুশিয়ারার তীরে বসে শেষদেখা সেই খেয়া নৌকা পারাপারের দৃশ্য মনে পড়ে গেল। কোনো মাঝি উদাস সুরে গান ধরেছে : ওরে বধূর লাইগ্যা পরান কান্দে মোর। সে গান আর শোনবার সৌভাগ্য হয় না। মনে পড়ছে গ্রামের সুধীনদাকে। গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় হৃষ্টপুষ্ট মানুষটি। সবসময় মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। আমাদের শৈশবকালে তিনি ছিলেন এক পরম বিস্ময়। এই লোকটিকে ধরতে কত পুলিশ-দারোগাকে কতবার নাজেহাল হতে হয়েছে। কত দিন মুগ্ধ বিস্ময়ে সে যুগের কীর্তি-কাহিনি শুনেছি তাঁর মুখে। রূপকথার মতো মনে হয়। বনজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি ধরে গেছে। পেছনে ঘুরছে প্রেতের মতো বিদেশি আমলের আই-বি-র দল। বোমা তৈরি আর পিস্তল চালাবার ট্রেনিং দেওয়া হয় শিয়ালকুচির জঙ্গলে। সে-যুগও চলে যায়। আসে অসহযোগ আন্দোলনের দিন। মাঠের মাঝখানে সার দিয়ে দেশকর্মীদের দাঁড় করায় অত্যাচারী দারোগা কেশব রায়। পিঠ ফুটে রক্ত বেরোয়। চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। তবুও প্রাণপণে অস্ফুটস্বরে প্রতিকণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র।
সুধীনদা আশা দিয়ে বলতেন : আর দুঃখ কী? স্বাধীনতা এল বলে। ভাবী দিনের ভাবী মানুষ তোরা, দুঃখজয়ী কিশোর তরুণের দল।… আর কথা শেষ করতে পারেন না। দু-হাত দিয়ে বুক চেপে ধরেন। অনেকদিন ধরে এই এক যন্ত্রণায় ভুগছেন সুধীনদা। সেই যে-বার পুলিশ সুপারের সঙ্গিনের আঘাতে বুকের একটি পাঁজর ভেঙে গিয়েছিল, তখন থেকেই একটানা কথা বলতে কষ্ট হত সুধীনদার। আজ কোথায় তিনি। হয়তো স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে কোনো এক উদবাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়ে তিনি প্রাণ-রক্ষার দুস্তর প্রয়াস করছেন।
গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে আমরা গড়ে তুলেছিলাম কিশোর লাইব্রেরি। করোগেটেড টিনের ছাউনি দেওয়া ছোটো ঘর। কিশোরদের জন্যে হলেও সেটা ছিল গ্রামের সকলের প্রাণ। যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সকলের অবসর বিনোদনের একমাত্র আশ্রয়কেন্দ্র। লাইব্রেরির পাশেই খেলার মাঠ। ফুটবল খেলার মরশুমে একটা-না-একটা প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত প্রতিদিন। অগণিত দর্শক। শুধু ছেলেরাই নয়–হুঁকো হাতে নিয়ে প্রৌঢ়-বৃদ্ধরাও মাঠের সামনে এসে জড়ো হতেন।
বর্ষাকালে খালে-বিলে মাঠে ধু-ধু করছে জল–সমুদ্রের বুকে যেন গ্রামটি নির্জন একটি দ্বীপ। শুরু হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। প্রতিপক্ষের চিৎকার–নৌকার দাঁড়ের শব্দ আর অসংখ্য দর্শকের উজ্জ্বল কলরব–কী ঊর্মিমুখর জীবন! মনে পড়ে ছোটো গ্রামখানার ছোটো ছোটো মানুষগুলোকে। বহির্জগতের সঙ্গে হয়তো তাদের সম্পর্ক ছিল না–নিজের গ্রাম এবং আশপাশে আত্মীয়স্বজন ছাড়া বহু মানুষের সঙ্গে হয়তো তারা মেশেনি,তবু কত সরল তাদের অন্তর কত বিষয়ে কত বাস্তব অভিজ্ঞতা! আকাশের দিকে চেয়ে ঠিক বলতে পারবে তারা, বৃষ্টি কখন হবে। সবুজ মাঠটার দিকে একবার স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি বুলিয়েই আনন্দে হয়তো মুখমন্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল একজনের। সে বললে-ফসল এবার হবে ভালো। আর ডোবার জল দেখে নির্ঘাৎ বলে দিল–প্রচুর মাছ আছে এর ভেতর। আশ্চর্য মানুষ এরা, বিচিত্র বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ এদের জীবন। নবীন মাঝি, তারক দাস, করিমুদ্দিন, শেখ সমীর এদের কি কখনো ভোলা যায়? প্রতিবার বাড়ি গেলে ঠিক এসে একবারটি খবর নেবে সমীর –ক্যামন আছ। তারপর এক কাঁদিকলা, নিজ হাতে ফলানো শাকসবজি নিয়ে এসে বাড়ি উপস্থিত–দাদাবাবুর লাইগ্যা আনলাম। পাষাণ-হৃদয় ছিল করিমুদ্দিন। একে একে তিনটি ছেলে এবং বউ একই মাসের ভেতর কলেরায় মরবার পরও লোকটাকে বিচলিত হতে দেখেনি কেউ। কিন্তু আমি জানি সেটা যে কত মিথ্যা। তার ভেতরের রূপ যে বাইরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। …একা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে গ্রাম ছাড়িয়ে কবরখানার কাছে পৌঁছেছি। সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার মিলিয়ে গেছে। সমস্ত শরীর ভয়ে শিউরে উঠল। ওই যে অল্প দূরে কী যেন নড়ছে, কে ও? স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু একী, মূর্তিটা যে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তবে যাই হোক, এ প্রেত নয়। কাছে আসতে বিস্ময়ের সীমা রইল না। আমায় সামনে দেখে হাউ হাউ করে কান্না শুরু করল করিমুদ্দিন। হঠাৎ খেয়াল হল। বহুদিনের নিরুদ্ধ আবেগ আর বাঁধ মানছে না করিমুদ্দিনের। মাথায় হাত দিয়ে রাস্তার ওপরেই বসে পড়ল আকাশের দিকে হাঁ করে চেয়ে। সান্ত্বনা দেবার মতো আমার কিছুই ছিল না, ধীরে ধীরে হাত দুটো ধরে অনেক দূর অবধি আনলাম ওকে। ওর মনের ভাষাটা তখন ঠিক রূপ নিয়েছে। যেন-’মোর জীবনের রোজ কেয়ামত, ভাবিতেছি, কতদূর!