তারকেশ্বরের মা সবার বড়োমা। তিনি ধান বরণ করতেন দুৰ্বায়, বরণকুলায়, মঙ্গলঘটের জলে আর মঙ্গলপাখার বাতাসে। প্রথম আঁটি ধান এইভাবে ঘরে আনা হত। চাষিরা বিদায় পেত নতুন কাপড় ও গামছা।
চাষিদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সব জাতই থাকত এবং তারা সবাই এইসব অনুষ্ঠান পালন করত।
চৈত্র মাসে হত ‘গৌরীর নাচ’। হিন্দু-মুসলমান সবাই এই উৎসবে যোগ দিতেন। ঢাকি-টুলি চলে মনোজ্ঞ ফুলসাজে সজ্জিত হরগৌরীর পিছু পিছু। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে শোভাযাত্রীরা গেয়ে বেড়ায়,
আজুয়া গৌরীর মালা-চন্দন
কালুয়া গৌরীর বিয়া,
ওরে গৌরীরে নিতে আইল শিব
চুয়া-চন্দন দিয়া।…
মূল গায়েন গায় ‘আজুয়া গৌরীর…’ ইত্যাদি। পিছনে সবাই ধুয়া ধরে। বাজনার তালে তালে হরগৌরী নাচে।
ছোটো একখানা পেতলের সরাই থাকে গৌরীর হাতে। নাচের ফাঁকে ফাঁকে গিন্নিমাদের কাছে তাদের পাওনা আদায় করে।
চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিনকে বলে ‘ফুলবিষু’। এই নামকরণ অর্থহীন নয়। ফুলের মালায়, নিমপাতায় আর কেয়া কাঁঠালের ফালিতে বাড়ির দরজা-জানালা সাজানো হয়। বাড়ির সব কিছুকেই মালা পরানো হয়, এমনকী আসবাবপত্র এবং গৃহপালিত পশু-পক্ষীও বাদ পড়ে না।
চৈত্র সংক্রান্তির কয়েকদিন আগে থেকেই ঘরে ঘরে খই, চিড়া, নারকেল, তিল, চালতা, কুল ও গুড় প্রভৃতির মিশ্রণে নাড় তৈরি হয়। এই নাড়কে আমাদের চাটগাঁয় বলে ‘লাওন। সংক্রান্তি বা বিষ্ণুপর্বের দিন চলে এই ‘লাওন’ খাওয়ার উৎসব। এই উৎসবের মধ্য দিয়েই হত বর্ষাবিদায় এবং হিন্দু-মুসলমানের নববর্ষ বরণের আন্তরিক শুভকামনার বিনিময়।
জ্যৈষ্ঠ মাসে চলত আম-নিমন্ত্রণ। চট্টগ্রামের পল্লির এই এক বৈশিষ্ট্য। একে অপরকে আম খেতে নিমন্ত্রণ করবেন। নিমন্ত্রণ রক্ষা না করলে অসুখী হবেন–অনুযোগ করবেন।
মোটামুটি এই হচ্ছে আমার গ্রাম সারোয়াতলির পুজোপার্বণ।
গ্রামটি একেবারে ছোটো নয়। স্কুল, ডাকঘর ও দাঁতব্য চিকিৎসালয় আছে, আর আছে মাইলখানেকের মধ্যে কানুনগোপাড়ায় একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ।
চট্টগ্রামের স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশ তার পাহাড় ও নদীর গাম্ভীর্যের মধ্যে গড়ে-ওঠা যেসব মানুষ দেখেছি, আজ তাদের মধ্যে প্রথম মনে পড়ছে যোগেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়কে। ধনীর সন্তান, জমিদারের ছেলে, কিন্তু নির্লিপ্ত এই মানুষটি বিষয়বৈভবের কোনো খবরই রাখতেন না।
এল ভাগ্য বিপর্যয়। তিনি আপনা থেকে কেমন করে জানতে পারলেন যে, তাঁর গৃহদেবতা মা কালীর নিত্যভোগ বন্ধ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আহার বন্ধ করলেন। এরপর যে তিন মাসের মতো বেঁচেছিলেন, তার মধ্যে অন্ন আর গ্রহণ করেননি। একটুখানি হাসি দিয়ে সকলের অনুরোধ এড়িয়ে যেতেন।
তাঁকে দাদুমণি বলে ডাকতাম। কথার ফাঁকে বন্দি করে একদিন দাদুমণিকে অনুগ্রহণের অনুরোধ জানালাম। তাঁর করুণ মুখে মলিন হাসি অশ্রুরাশির মধ্যে ডুবে গেল। চুপি চুপি আমায় সব জানালেন, বললেন–ওই অনুরোধ তুই আর আমায় করিসনি ভাই।
আর আজ মনে পড়ে গ্রামের তারকেশ্বরদা ও রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে–’ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান’। মনে পড়ে–শাসকশক্তির অত্যাচারের করাল রূপ। তারকেশ্বর-রামকৃষ্ণের পরিচয় বাঙালি পাঠককে দিতে হবে না জানি, কিন্তু সেদিন গ্রামের উপর দিয়ে অত্যাচারের যে ঝড় বয়ে গেছে–সে-কথা স্মরণ করলে এখনও শিউরে উঠি।
চোখের উপর ভেসে ওঠে একদিনের নির্মম ছবি। ভোরবেলায় গভীর আতঙ্কে গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙল-ভয়ে কারও মুখে কথা সরে না। জ্বলে উঠল তারকেশ্বর, রামকৃষ্ণ ও বিশিষ্ট কংগ্রেসকর্মী প্রসন্ন সেন মহাশয়ের বাড়ি।
পুলিশ সুপার সুটার সাহেবের কতৃত্বাধীনে সারোয়াতলিকে মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়া হল। তারা তারকাঁটা দিয়ে কালাইয়ার হাটের পাশে গ্রামের হাই স্কুলটাকে ঘিরে ফেলল। শুরু হল লাঠি-বৃষ্টি, বেয়নেটের খোঁচা ও বন্দুকের কুঁদোর আঘাত। তৃতীয় শ্রেণির শিশু থেকে দশম শ্রেণির কিশোর কেউই বাদ পড়ল না– এমনকী শিক্ষকরাও প্রহারে জর্জরিত হলেন।
এই অত্যাচার থেকে বোরলা, কানুনগোপাড়া প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিও রেহাই পায়নি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর জালালাবাদে চলে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইংরেজ সরকারের প্রথম সশস্ত্র সম্মুখ সংগ্রাম। এই যুদ্ধের অধিনায়ক ছিলেন লোকনাথ বল। তাঁর ভাই টেগরা এবং আরও কয়েকজন সেখানে শহিদ হয়েছিলেন। তারকেশ্বর, রামকৃষ্ণের বাড়ির মতো লোকনাথদার বাড়িও ভস্মীভূত হয় সেই সময়।
তখন দেখেছি গ্রামের সকলের তাঁদের প্রতি কী সহানুভূতি ও সমবেদনা! বিদেশি শাসকের অত্যাচারে এদের মনেও বেজে উঠত বিদ্রোহের সুর।
অশিক্ষিত চাষাভুষোর দল বিদ্রোহীদের লুকিয়ে রাখতেন–তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান। তাঁদের ঘরের মায়েরাও ‘স্বদেশি ছেলেদের’ কত যত্নই না করতেন। তাঁদের মুখে প্রায়ই শুনতাম—’আহারে দুঃখিনীর পোয়া, তোরা আখেরে রাজা হবি। তোরার দুঃখ খোদার দোয়ায় ঘুচিব।’
শুনছি সেই রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের বাড়ি তাঁদেরই এক প্রজা জোর করে দখল করেছে। তারকেশ্বরদাদের বাড়ি নিয়েও চলেছে সীমাহীন লোভের হানাহানি। আর স্বর্গীয় প্রসন্ন সেন মহাশয়ের পরিবারবর্গ আজ উদবাস্তু, পশ্চিমবঙ্গে সরকারের আশ্রয়প্রার্থী। শুধু ভাবছি নিয়তির এ কী কঠোর পরিহাস!