সন্ধ্যাকালে সংকীর্তনের সুর ভেসে আসত কানে। গাঁয়ে এক সাধুর আজ্ঞা ছিল–সেখানে বাউল-কীর্তন বেশ জমে উঠত গোপীযন্ত্রের সঙ্গে। ঠাকরুনতলার স্কুলঘরে চলত গ্রামের যাত্রাদলের মহড়া। চাষি যুবকদের অশুদ্ধ উচ্চারণে বীররস প্রকাশ, স্ত্রীভূমিকায় পুরুষকণ্ঠের বিকৃত চিৎকার আজও স্পষ্ট যেন শুনতে পাই।
মেঠো পথে অন্ধকারে পথ চলছে হাটুরে লোক-হাট থেকে ফিরছে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি ঘরকন্নার কথা বলতে বলতে। অন্যান্য বেসাতির সঙ্গে ছেলে-মেয়ের জন্যে হয়তো নিয়ে চলেছে একপয়সার বাতাসাওরা বলে ‘ফেনি’; বউ-এর জন্যে কাঁচের চুড়ি আর নিজেদের জন্যে তামাক। পরস্পরের আলাপের যোগসূত্র হল এই তামাক।
ছায়াছবির মতো কত স্মৃতির ছবি ভিড় করে আসে মনের পর্দায়। তাল খেজুর নারকেল সুপারি আম কাঁঠালের দেশ, জলকাদায় স্নিগ্ধ যার কোল, জোলো হাওয়ায় আন্দোলিত যার সবুজ আঁচল, মেঘে-রৌদ্রে হাসিকান্নায় মুখর যার গৃহাঙ্গন–সেই জন্মভূমি পল্লিমায়ের মুখখানি আজ বারবার মনে পড়ছে। ঋতু বিবর্তনের বিচিত্রতা, পল্লির সবুজ চোখজুড়ানো স্নিগ্ধতা, আকাশের প্রসারতা, দিগবলয় ঘেঁষা বিলের রহস্যময়তা আজও আমাকে নীরবে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সোনার বাংলার লক্ষ গ্রামের সেই এক গ্রাম–তাকে আজ আমি কেমন করে ভুলি? শিশু কি কখনো মায়ের কোল ভুলতে পারে? মহাকালের নির্মম পরিহাসে মাকে ছেড়ে চলে আসতে হল দূরপ্রবাসে অশ্রুজল সম্বল করে, ওপারের মানুষ এপারে এলাম শরণার্থীর বেশে। সেই বিলের জলের মতো ছলছল করা আমার জননী জন্মভূমির চোখের জল প্রাণের গহনে যে কান্না জাগায়–কেউ কি তা বুঝবে? আমাদের সেই ঠাকরুনতলায় কালীপুজোর জন্যে সংগৃহীত ছাগশিশুদের মতো রাজনৈতিক যূপকাষ্ঠে আজ লক্ষ লক্ষ মানবশিশু বলি হতে চলেছে। কিন্তু সত্যি কি তাই হবে? ঘরের ছেলেরা কি আর ঘরে ফিরবে না?
চট্টগ্রাম – সারোয়ালি ধলঘাট ভাটিকাইন গোমদন্ডী
সুদীর্ঘ আট-দশ হাত চওড়া আরাকান রোডের দু-পাশে দেখা যায় আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের এক বিশিষ্ট রূপ। রাস্তার দু-ধারে সারবন্দি বড়ো বড়ো গাছ–অশ্বথ, বট, আম, সোনালু আর গামার। নব কিশলয়ে ফুলে ফুলে তাদের বসন্তশ্রী মনে জাগায় সৃষ্টিকর্তার রসমাধুর্য। কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি রং ধরায় মানুষের মনে, ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস বকুলফুল কুড়োবার জন্যে ডাকে।
অদূরে ‘করেলডেঙ্গা’ পাহাড়। নিবিড় শ্যামল আস্তরণের ফাঁকে ফাঁকে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। সোনালি রঙের সোনালু ফুল, বেগুনি রঙের গামার, বনকরবী, অজস্র কাঠ-গোলাপ ও কাঠ-মল্লিকা। পাহাড়ের গা-বেয়ে ছোটো ছোটো ঝরনা নেমে এসেছে, তার পাশে কোথাও কোথাও শণখেত। নীচে দিগন্তপ্রসারী মাঠ, বুকে তাদের নানান ফসল। তারপরই আম, জাম, সুপারি, নারকেল আর খেজুর গাছের ঘন অন্তরালে আমার জন্মভূমি কঞ্জুরি মৌজার সারোয়াতলি গ্রাম। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় থেকে বাইরের লোকে জেনেছে ‘সেওড়াতলি’ বলে।
কর্ণফুলির বহু শাখাপ্রশাখা গাঁয়ের ভেতর প্রবেশ করেছে। ছবির মতো তাদের রূপ তাদের প্রায় সবগুলিতেই বারোমাস নৌকা চলে।
আষাঢ়-শ্রাবণের ঘন বর্ষণেও রাস্তাঘাট ডোবে না, চারিদিক অপূর্ব শ্যামশ্রীতে ভরে যায়। পুকুর-দিঘির টলটলে জলের ওপর নানা রঙের শাপলাফুল ও পদ্মের অপরূপ সৌন্দর্যে চোখ জুড়ায়।
ভরা বর্ষায় খালেবিলে ছোটো নেংটি-পরা ছেলে-মেয়েদের মাছ ধরার হিড়িক পড়ে। এক একটি মাছ পলো চাপা পড়ার পর তাদের উচ্ছ্বসিত হাসি ও চিৎকারে প্রকৃতির সজল রূপের মাধুর্য বেড়ে যায়।
শ্রাবণ মাসের আনন্দমা মনসার আগমন। পয়লা শ্রাবণে ঘরে ঘরে মা মনসার ঘট বসে –প্রতিরবিবার ঘটের পল্লব বদলানো হয়। প্রত্যেকদিনই মনসার পুথি পড়া হয়—’বাইশ কবি মনসাপুথি’ অর্থাৎ বাইশজন কবির লেখা মনসামঙ্গল। একজন সুললিত কণ্ঠে পুথি পড়েন –কয়েকজন দোহার ধরেন। মধ্যে মধ্যে চলে গীতবাদ্য। কোনো কোনো বাড়িতে এই উপলক্ষ্যে ভোজ হয়। সংক্রান্তির দিন ঘটা করে মায়ের পুজো। পুজোয় পাঁঠা, হাঁস, কবুতর বলি পড়ে। কেউ কেউ বলি দেন আখ বা চালকুমড়ো৷
আসে শরৎ। শারদলক্ষ্মীর শুভ আগমনে প্রকৃতির সঙ্গে মানবহৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে। ভোরবেলার শান্ত বাতাসে ভেসে আসে শিউলি ফুলের গন্ধ, দারোগাবাড়ির মঙ্গল আরতির ঘণ্টা, কাঁসর-শাঁখের পবিত্র শব্দ আর বড়োপিরের দরগা থেকে আসে সুমধুর আজান ধ্বনি।
দুর্গা পুজোয় নাগ ও মহাজনদের বাড়িতেই ধুমধাম হয় সবচেয়ে বেশি। গ্রামের প্রায় সবাই তাতে যোগ দেয়। তবে বিশেষ করে নাগেদের বাড়ির নবমী পুজোর বলি দেখবার জন্যে সারাগ্রামের লোক ছুটে যায়। বলির মোষের শিং দুটি সিঁদুরে রাঙিয়ে তার গলায় বেলপাতা ও জবা ফুলের মালা পরানো হয়। সাজতে হয় ঘাতককেও। মাথায় জবাফুলের মালার পাগড়ি, হাতে খঙ্গ–সালুপরা, সিঁদুর-রঞ্জিত সেই মূর্তিকে আজও ভুলতে পারিনি! ভুলিনি বলির পর তার ‘ঘাতক নাচ।
মনে পড়ে ছোটোবেলায় একবার বলির আগেই ছুটে পালিয়ে এসেছিলাম। বলির মোষের চোখের কোণে জলের ধারা আমার শিশুমনের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিল–আজও সেই ছবি আমার মন থেকে মিলিয়ে যায়নি।
পুজোর উৎসবের পরই মনে পড়ে ধান কাটার আনন্দের কথা। কোনো কোনো গৃহস্থের ধান কাটার সময় ঢাক-ঢোলের বাদ্য-বাজনা হত। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের আসামি তারকেশ্বরদাদের জমির ধান কাটা দেখতে জড়ো হতাম ছেলেবেলায়। খুব ভোরে বাজনদারেরা এসে সানাইয়ের তান ধরতেই দলে দলে চাষির দল জমায়েত হত। রাঙা গামছা কোমরে বেঁধে, কাঁচির ডগায় সিঁদুর লাগিয়ে সবাই রওনা হত মাঠের দিকে। মাঠজোড়া অনেক জমি, তাতে ধান কাটা চলত দিনরাত। সঙ্গে চলত বাজনা আর চাষিদের খাওয়া।