দিগন্ত ছোঁয়া বিলের একপাশে ছোটো সেই চাষিপ্রধান গ্রাম। বিলভরা অথৈ জল। সবুজের সমুদ্র-ধানগাছের ওপর বাতাস দিয়ে যায় ঢেউ-এর দোলন। মাঝে মাঝে শাপলা কচুরিপানার ফুল; নল-হোগলা-চেঁচো বন। বিলের ওপরে ওড়ে বক, পানকৌড়ি, গাংশালিক, ক্ষণে ক্ষণে লাফিয়ে চলে গঙ্গাফড়িং।
আশ্বিন-কার্তিকে সোনার রং লাগে মাঠে মাঠে-লক্ষ্মীর অঙ্গের আভা ওঠে ফুটে। অঘ্রানে পৌষে দেবীকে বরণ করে চাষিরা তোলে ঘরে। তাঁর দেহের সৌরভে বাতাস মধুময় হয়ে ওঠে। পথে-ঘাটে-মাঠে ঘরের আঙিনায় নতুন ধানের প্রাণ-মাতানো সুবাস। ঘরে ঘরে আঁকা হল আলপনা, চলল উৎসব–নবান্ন, পৌষ-পার্বণ-নারকেল-নলেন গুড়ের গন্ধে ভুরভুর চতুর্দিক। চাষির ঘরে দারিদ্র্য আছে, কিন্তু অলক্ষ্মী নেই। দিঘল ঘোমটা-টানা ছোটো ছোটো বধূরাও জানে বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীকে মাটির ঘরে বেঁধে রাখবার মন্ত্র। তাদের ডাগর ডাগর কালো চোখের সরল চাউনি–আজও যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
নৌকা-ডোঙা নিয়ে বিলের বুকে আনাগোনা করে ছেলে থেকে বুড়ো সবাই। ধরে মাছ, ধরে পাখি, কাজকর্মের অবসরে। মাছ নইলে ওদেরও মুখে অন্ন রোচে না। এপারে ফুলতলা আর ওপারে দৌলতপুর স্টেশন। রেলগাড়ির যাওয়া-আসা দেখে চাষিরা সময়ের ঠিক করে নেয়। ওরা বলে ৫টার গাড়ি, ৮টার গাড়ি, ১২টার গাড়ি। অসময়ে যায় মালগাড়ি। রেলগাড়ি চলে দেশ হতে দেশান্তরে, চাষিরা মাঠ থেকে, চাষি-বউরা ঘাট থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যন্ত্রদানব ধূম উদগিরণ করতে করতে চলে গেল। কোথায় কোন দেশে গেল কে জানে?
রেললাইন পার হয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা সড়ক মুসলমান পাড়ার মধ্য দিয়ে চলে গেছে। জোলা পাড়ার তাঁতগুলো চলছে ঠকঠকঠক। দু-পাশ থেকে বাঁশঝাড় নুয়ে পড়ে প্রায় সারাপথটাই ঢেকে রেখেছে। বাঁশপাতা পচা একটা সোঁদা গন্ধ নাকে আসে।
‘বাবু, দ্যাশে আলেন নাহি?’–মুসলমান চাষি সহজ সৌজন্যে কুশলপ্রশ্ন করে। সৈয়দ মুনশির বাড়ির কাছে এলে ওষুধের তীব্র কটুগন্ধ নাকে আসে। উনি কবিরাজিও করেন, আবার মাস্টারিও করেন। এঁর কাছেই আমার জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ। সদা হাসিমাখা মুখ–শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। মাস্টারি ও কবিরাজি ওঁর উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া। ওঁর বাবা ছিলেন রহিম মুনশি, তখনকার দিনের জি. টি. পাস। দীর্ঘদেহ রাশভারী লোক ছিলেন। আমাদের গ্রামে ছোটো ছেলেপুলের কিছু হলেই এঁদের ডাক পড়ত। ভিজিটের কোনো দাবি ছিল না দেওয়ার কথা কারুর মনেও হত না। তবে বাড়ির ফলটা তরকারিটা দেওয়া হত প্রায়ই। আজও যেন তাঁদের আত্মার আত্মীয় বলে মনে হয়। হিন্দু-মুসলমান এতদিন আমরা পাশাপাশি বাস করেছি ভাই-ভাইয়ের মতন–চিরকাল সকলের সঙ্গে একটা আত্মীয়তার যোগ অনুভব করেছি। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি জমি চাষ করেছি; এ আলের ওপর একদল খেয়েছে পান্তা –আর একদল করেছে নাশতা। কল্কে চাওয়া-চাওয়ি করে তামাক খেয়েছে। কুস্তি, খেলা, আড়ং-এ সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করত–আবার কবিগান, জারিগান, গাজির গান, রামায়ণ গান–সব কিছুরই রস উপভোগ করত রাত জেগে পাশাপাশি বসে। আর আজ?
মুসলমানপাড়া ছাড়ালেই আম-কাঁঠাল-তাল-খেজুরের ভিটে পড়ে আছে। কোথা থেকে ঘুঘুর একটানা উদাস ডাক কানে ভেসে আসে। কোকিল ডাকে। কখনো-বা শোনা যায়, ‘চোখ গেল, চোখ গেল’, মন উধাও হয়ে যায় যেন কোন স্বপ্নরাজ্যে। সরষে ফুলে, তিল ফুলে মাঠ গিয়েছে ছেয়ে। ফিঙে লাফায় ফুলে ভরা বাবলা গাছে। বনফুলের গন্ধে উতলা মেঠো হাওয়া দেহে বুলোয় মায়ের হাতের পরশ। দূর থেকে দেখা যায় ঠাকরুনতলা। বিশাল এক বটগাছ–অসংখ্য ঝুরি নেমেছে বিরাট বিরাট ডালপালা থেকে। সর্বজনীন দেবস্থান। গ্রামের সাধারণ ক্রিয়াকর্ম যা কিছু এখানেই হয়ে থাকে। গাজন, কালীপুজো আরও কত কী। এই ঠাকরুনতলার এক পাশে ছিল আমাদের সৈয়দ মুনশির পাঠশালা। বটগাছের শীর্ষদেশে বংশানুক্রমিক সন্তান-সন্ততি নিয়ে কয়েকটা চিল বাস করত–অন্যান্য ডালপালায় কোটরে থাকত আর সব নানা জাতের পাখি। শেষরাতে চিলের ডাকে পল্লিবধূরা রাতের শেষপ্রহর জানতে পেরে শয্যাত্যাগ করত। তারপর ছড়া, ঝাঁট, প্রাতঃস্নান প্রভৃতি থেকে দিনের কাজ হত শুরু। আর পুরুষেরা লাঙল-গোরু নিয়ে ছুটত মাঠে।
ছোট্ট গ্রাম ডাকাতিয়া। তাই বলে ডাকাত বাস করে না এখানে-কিংবা নেই তাদের কোনো অনুচর। দিগন্তপ্রসারী ডাকাতিয়ার বিল। সচরাচর এত বড়ো বিল দেখা যায় না। তার পাশের ছোট্ট এই গ্রামটি তারই নাম পেয়েছে। ডাকাতিয়ার বিলের হয়তো কোনো ইতিহাস আছে–কিন্তু আজ আর সে-কথা কেউ জানে না। তবে খালপারের মাঠে লাঙল দিতে দিতে চাষিরা নাকি অনেক সময় কোম্পানির আমলের পয়সা পেয়ে যায়। খালপারের ভিটের কাছেই একটা মজা পুকুর আছে–পূর্বে নাকি এখানেই ছিল মস্ত বড়ো এক দিঘি। পুকুরের পাড়ে একটি বড় আমগাছ আজও আছে। কয়েক পুরুষ আগে নাকি কখনো কখনো চাষিরা দেখতে পেত–দিঘির মধ্যে ছোট্ট একটা রুপোর নৌকা ভেসে উঠত–আর নৌকাটি ওই আমগাছের গুঁড়ির সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা। ওই নৌকায় মোহরভরা সোনার কলসিও নাকি ঝিকমিক করে উঠত। কিছুক্ষণ ভেসে থেকে আবার ইচ্ছামতো সে নৌকা তলিয়ে যেত দিঘির অতল কালো জলে।
বিলের ওপারে দিনের শেষে সূর্য ডোবে সোনার একখানা বড়ো থালার মতো কাঁপতে কাঁপতে। সেই সূর্যের লাল রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে দিগদিগন্তে। ছোটোবেলায় বসে বসে দেখতাম –কত যে ভালো লাগত! সূর্যাস্তের পর যখন গোধূলির স্লানিমা কাঁপতে থাকত–স্বপ্নবিহার থেকে মন নেমে আসত মাটিতে। বাঁশঝাড়ে-তেঁতুল কিংবা আমগাছে বিলে-চরা বকের ঝাঁক সাদা ডানা মেলে এসে কোলাহল করত–অসংখ্য শালিক কিচিরমিচির ডাকে কীর্তন জমিয়ে তুলত। গ্রামের মেয়েরা সাঁঝের পিদিম নিয়ে আলো দেখাত তুলসীতলায়, ধানের গোলায়, ঠাকুরঘরে। অন্ধকার নিবিড় হয়ে আসত। ঝোপেঝাপে, লতাকুঞ্জে জোনাকির ফুলঝুরি ফুটত। কোনো কোনোদিন বাঁশবাগানের মাথার ওপর যেন পথিক চাঁদ পথ ভুলে এসে তাকিয়ে থাকত।