এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিল চন্দ্রাবলী একা। পরে বহুবার সে এই প্রায় অলৌকিক সৌন্দর্যের স্মৃতিচারণ করেছিল। তার বর্ণনা থেকে এমনকী শুভদীপ নিজেও প্রত্যক্ষ করেছিল নিজস্ব অলৌকিক সুন্দর রূপারোপ। মোটা বেঁটে, গোল, কালো চন্দ্রাবলীর হলুদ সালোয়ার কামিজে জ্যোৎস্না লেগে তখন মায়াবী রং। দোপাট্টা উড়ছে হাওয়ায়। আর চাঁদের গা থেকে ফোঁটা ফোঁটা আলো পড়ে শুভদীপের চশমার কাচ, সাধারণ পরকলাদ্বয়, কীরকম স্বপ্নিল হয়ে যাচ্ছে তার প্রতি মৌহুর্তিক বর্ণনা জানতে পারছে সেই। আর তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে সুর। শুধু সুর। সেই সুরের ভিতর কোনও ভাষা নেই। কোনও বাণী নেই। ধ্বনি নেই কোনও। এক শব্দতরঙ্গ সম্বল। সেই তরঙ্গ আশ্রয় করে সুর ভেসে যাচ্ছে জলে। মিশে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। শুভদীপ দেখছে। শুনছে। ভাবছো রবিদার বাড়িতে বার কয়েক গিয়েছে সে। চন্দ্রাবলীকে দেখেনি। চন্দ্রাবলী একটি গানের স্কুল চালায়। আর চন্দ্রাবলী চোখ বন্ধ করে সুর তুলছে এমন–তার দু’গালে সরু জলের ধারা। হাওয়া সেই সুর বয়ে নিয়ে চলেছে নৌকায় আর নৌকা পেরিয়ে অসীমে। ওই হাওয়া, ওই নদীর জোয়ার, জলে ছলাৎছল, ওই জ্যোৎস্নায় চাঁদ আর ছলাৎছলে মিশে যাওয়া চাঁদের প্রতিবিম্ব, ওই সুর আর কালো মাংসল গালে লেগে থাকা নোজল-সব মিলে শুভদীপের হাত প্রসারিত করে দেয় আর সে স্থাপন করে, আলতো স্থাপন করে চন্দ্রাবলীর মাথায়। স্পষ্ট টের পায়—চন্দ্রাবলী কাঁপল। কেঁপে উঠল। বন্ধ করল গান। জানাল, এ চন্দ্রকোশ। মালকোশের খুব কাছাকাছি চন্দ্রকোশ। কিন্তু নরম। বড় নরম। শুনতে থাকলে, গাইতে থাকলে কান্না পেয়ে যায়।
আজ, এই কবরস্থানে, দিঘির এই শীতার্ত পারে, শুভদীপ সেই চন্দ্রকোশের সুরকে স্পর্শ করল স্পষ্ট।
কেন-না, জ্যোৎস্না নেমে এসেছে জলে। আর লেগেছে হাওয়া। ঘোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় আলোর চিকচিক। সে ছটফট করছে। মুঠোয় ধরছে। চন্দ্রাবলীর স্তন। বড় ভারী স্তন। মেদবহুল পেটের মধ্যে হাঁটু চেপে রাখছে। এখন, এই প্রক্রিয়ার আগে তার শীত চলে যাচ্ছে। এক কামভাবে কানের লতিতে আগুন। সে তার শিশ্ন সম্পর্কে অতি বিচলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এলেন। মনে করিয়ে দিলেন, সন্ধে পেরিয়ে গেছে, এবার যেতে হবে। সে উঠে দাঁড়াল তখন। তিনি কোনও প্রশ্ন করলেন না। অন্ধকারে কবরগুলি অসংখ্য ছোট ছোট স্তৃপ। গাছপালা ভেদ করে জ্যোৎস্না নামেনি। পোঁছয়নি আলো। সে হেঁটে চলল বৃদ্ধের পেছন পেছন। এবং টের পেল, সেই আশ্চর্য গন্ধ তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে এবার। মনে পড়ল তার। মৃত্যুকে উপলব্ধি করার পরিবর্তে এতক্ষণ অনর্থক ভেবে গিয়েছে সে। এর জন্য চন্দ্রাবলীকেই সে দায়ী করে বসে মনে মনে এবং ঘৃণা ওগড়ায়।
কবরস্থানের গেট পেরিয়ে বাইরে আসতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় তার। আধুনিক আলোক প্রক্ষেপণ কৌশলে। বিজ্ঞাপনের মেয়েটি এখন অনেক বেশি আবেদনপূর্ণ। প্রায় ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠেছে তার অবয়ব। সে মেয়েটির চোখ দেখে। বুকের খাঁজ। উরুর মসৃণতা দেখে আর ঠোঁটের আকর্ষণ। তার মেয়েটিকে ছুঁতে ইচ্ছা করে আর সেই মেয়ে বিজ্ঞাপনের ছবি থেকে নেমে তার গা ঘেঁষে চলে যায়। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় ঘাড় ফেরানো চাউনির মধ্যে আকর্ষণ। সে আকর্ষণ অনুসরণ করে এবং বুঝে পায় না বিজ্ঞাপনের মেয়েটি ছোট পোশাক খুলে সালোয়ার-কামিজ পরে নিল কখন। ছোট চুলে কখন বসিয়ে নিল সুদীর্ঘ বিনুনি। সাদা ত্বক কোন জাদুবলে হয়ে গেল মাজা-মাজা। শুধু আবেদন এক। দৃষ্টি ও দেহের আবেদন সদৃশ। সে মৃত্যুর সংকল্প বিস্মৃত হয় তখন। কবর বিস্মৃত হয়। ভুলে যায় সমাহিত বৃদ্ধকে আর অদ্ভুত ঘ্রাণ। সে হেঁড়া জুতো বিস্মৃত হয়। এমনকী চন্দ্রাবলী সম্পর্কে ঘৃণাও টের পায় না। এক আগুনের বৃত্ত তাকে ঘিরে ফেলে ক্রমশ এবং পোশাক ও ত্বক অবিকৃত রেখে শরীরে ঢুকে যায়। আর মেয়েটি কবরখানা থেকে অল্প দূরে একটি বাতিস্তম্ভের নীচে দাঁড়িয়ে অনুচ্চে কথা বলে। জানায়, পাঁচশো। জানতে চায়, হতে পারে কিনা।
শুভদীপ থমকে দাঁড়ায়। শীত-পরাস্ত কপালে বড় বড় স্বেদবিন্দু জমে। আঠাশ বছর বয়সে এই প্রথম সে কোনও শরীর বিকিকিনির মুখোমুখি। কানের লতি থেকে ফুলকি ঝরে তার। আর দাহ্য শরীরকে তৎক্ষণাৎ আগুন বেষ্টন করে। হাড় জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে যায়। ত্বক ভেদ করে ফুটে বেয়োয় লালচে গনগনে আঁচ। গলা অবধি শুকনো। স্বর ফোটে না যথাযথ। আড়ষ্ট জিভে বাক্য উচ্চারিত হয় না যথাযথ। তবু সে সেই আধফোটা খসখসে স্বর দ্বারা জানায় তিনশো। তিনশোই সে দিতে পারে সর্বোচ্চ দাম। বিজ্ঞাপনের মেয়ে নিজেকে বার কয়েক নিলাম করে। অতঃপর তিনশোতেই রাজি হয়ে যায়। শুভদীপকে সঙ্গে আসতে বলে। শুভদীপ সঙ্গে-সঙ্গে যায়। সম্মোহিত। অথবা স্বগোথিত। কিংবা আবেশদীর্ণ। মেয়েটি শরীরে শরীর ঘষটে চলে। বুক ছুঁইয়ে দেয় গায়ে। একসময় জানায়, শুভদীপ মদ খেতে চাইলে তিনশোয় হবে না। আরও পঞ্চাশ লাগবে। সে মদ খাবার অনিচ্ছে জানিয়ে হিসেব করে এবং আশ্চর্য হয়ে যায়। সে মেয়েটিকে দর বলতে প্রস্তুত ছিল না। অথচ প্রস্তুতি ছাড়াই সে বলে ফেলল সঠিক। তার কাছে সাড়ে তিনশো টাকাই আছে। দু’শো বিজ্ঞাপনের বকেয়া সংগ্রহ। একশো মা দিয়েছিল বাবার জন্য কিছু ওষুধ কিনতে। পঞ্চাশ তার পথ খরচ। ঘুরে-ঘুরে কাজ করে বলে তার সংস্থা তাকে দৈনিক ত্রিশ টাকা পথখরচ দেয়। সে বেঁটে মেরে দেয় দীর্ঘ পথ আর পয়সা বাঁচায়। বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে তার কাছে এখন কুড়ি টাকা বাড়তি।