আত্মস্থ ভাব থেকে তন্ময় হলেন তিনি। মুখে ফিরে এল হাসি। নিচু স্বরগ্রামে তিনি কথা বলে চললেন। একই কথা। হতে পারে, আর কোনও কথা নেই, ফুরিয়ে গিয়েছে সব। রয়ে গেছে এইটুকু। বার বার বলার। শোনানোর অন্যকে। শোনানোর নিজেকে। একা নন। একা নন। একা তিনি নন। এইসব কবরে শায়িত অসংখ্য মানুষকে তাঁর সঙ্গী মনে হয়। এইখানে শুয়ে আছে স্ত্রী, ছেলে, ভাই। তিনিও শুয়ে পড়বেন পাশাপাশি একফালি জায়গায়। বাজে, বেজে চলে আত্মগত স্বর। শুয়ে পড়বেন তিনিও। আর ভাবনা কী! শান্তি শান্তি। সব শান্তি। হারানোর বুকফাটা হাহাকার বেজেছিল একদিন। এখন শান্তি। সব শান্তি।
শুভদীপ দেখল, মানুষটির মুখ থেকে তন্ময় হাসি ছড়িয়ে পড়ল টুপটাপ, বকুল ফুলেরই মতো। আর তিনি, শুভদীপকে একা হতে দিয়ে, দু’হাত পেছনে জড়ো করে ফিরে চললেন আগের জায়গায়।
এই মানুষ, গোরস্থান আগলে রাখা মানুষ, মৃত লোকেরাই হয়ে উঠেছে তার জীবন। শুভদীপ মাথা নিচু করে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যায়।
অগুনতি কবরের সারি। ছোট, বড়, মাঝারি। নতুন ও পুরনো। জীবিতের সামর্থ্য অনুযায়ী মৃতের সমাধিফলকের কারুকাজ। মৃতের গুরুত্ব অনুযায়ী জীবিতের শ্রদ্ধা-ফলক। সে একটি বর্ণও পড়তে পারে না সেইসব ফলক থেকে। বরং একটি সুদৃশ্য শ্বেতপাথরের সমাধির কাছে দাঁড়ায়। টের পায়, এই জায়গাটিতে গাঢ়তর শীত ও সন্ধ্যার ইশারা ত্বক ভেদ করে ঢুকে পড়ছে। কুয়াশার দল এসে জমে যাচ্ছে সামনে কেন-না ওখানে আছে পাড়-বাঁধানো জলাশয়। বাইরের রাস্তা থেকে ভেসে আসা গাড়ির শব্দ ডুবে যাচ্ছে জলে। সে গিয়ে বসছে জলাশয়ের কিনার ঘেঁষে। একটি অজানা গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে সুগন্ধ নয়। দুর্গন্ধও নয়। নয় মাদকতাময়। নতুন ও গভীর এই ঘ্রাণ। হেতে পারে মৃত্যুর গন্ধ এই। হতে পারে সেই নিরপেক্ষ, নির্লোভ, শান্ত নারী যখন বেশবাস পরিবর্তন করে, তখন এমনই গন্ধ আসে গা থেকে তার।
সে শুয়ে পড়ল এবার। জলাশয়ের বাঁধানো পাড়ে শুয়ে পা ছড়িয়ে দিল। একটি-দুটি শুকনো পাতা খসে পড়ল গায়ে। তার হাতের সঙ্গে, পায়ের সঙ্গে, মাথার সঙ্গে, ব্যাগের সঙ্গে সংযুক্ত মহাবিশ্ব আবর্তিত হয়ে চলল আপন ইচ্ছায়। সে চোখ বন্ধ করল আর কুয়াশা এসে ঢেকে ফেলল অতীত আর বর্তমানের মধ্যবর্তী সীমারেখা।
তখন মাতলা নদীতে নৌকা ভাসাল মাঝিরা। বড় যন্ত্রচালিত নৌকা। পাটাতনে ছাউনি দেওয়া। রীতিমতো শয্যা পেতে দু’দিনের জীবন-যাপন। নৌকাতেই রান্না খাওয়া প্রাতঃকৃত্য শয়ন। কিছু অংশ খোলা। নদীর হাওয়ার জলসম্ভব ঝাপটা লাগছে সেখানে। সেই ঝাপটা মেখে, মদ্যপান করতে করতে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভাগের আয়োজন করছে অন্য যাত্রীরা। রবিদাও আছেন দলে। রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। রবিদা রান্নার ব্যবস্থাপনায়। তাঁকে একটু ব্যস্ত দেখাচ্ছে তাই। সে এসেছে রবিদার অতিথি হয়েই। আর রবিদার সঙ্গে আছে তাঁর স্ত্রী। কালো, মোটা, বেঁটে, গাভীর মতো ভাষাহীন অথবা শুধু বেদনার অভিব্যক্তিময় চোখ। সাধারণের চেয়েও সাধারণ, অনাকর্ষণীয় চন্দ্রাবলী। এক অপরূপা মহিলা রবিদার পাশে পাশে। তিনি চন্দ্রাবলীর দিকে ফিরেও দেখছেন না। এ দৃশ্য নতুন নয় তার চোখে। এই রবিদা ও অপরূপা মহিলারা। সুন্দরী মহিলাদের প্রতি রবিদার প্রসক্তি প্রবল। সে জানে এবং এই প্রসক্তিকে লাম্পট্য ভাবে। শুধু রূপ দ্বারা পুরুষ নারীকে জয় করতে পারে। শুধু গুণ দ্বারাও পারে আর রূপ বা গুণ না থাকলেও অর্থ ও সাহসের সঙ্গতি দ্বারা যুগ-যুগান্তর ধরেই সে পেয়ে যায় অগুনতি অপরূপা নারী।
রবিদা চন্দ্রাবলীর দিকে ফিরেও দেখছেন না। আর চন্দ্রাবলী তার সঙ্গে সঙ্গে আছে। সেও মদ্যপান করে না বলেই চন্দ্রাবলীকে সঙ্গী করে সরে আছে এইদিকে। চন্দ্রাবলী নানা কথা বলছে। সে-ও বলছে। আর দেখছে মাতলা নদী বেয়ে নৌকা ক্রমে ঢুকে পড়ছে খাঁড়িতে। নৌকার যন্ত্রের শব্দে নদী আর জঙ্গলের স্তব্ধতা ভেঙে খানখান।
দু’পাশে ম্যানগ্রোভ বন। উষ্ণ মণ্ডলের বৃক্ষরাজি ঝুঁকে আছে জলে। যেন এখুনি ডালপালা ডুবিয়ে গা ধোবে বসন্তের নীরে। কেন-না সেদিন পূর্ণ বসন্ত। সেদিন ছিল দোলের পূর্ণিমা।
সুন্দরবন ঘন ও গভীর হচ্ছে। সে আর চন্দ্রাবলী বসেছে পাশাপাশি আর একগুচ্ছ বক জল ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে পারে। আর এভাবেই ত্রস্ত হরিণেরা সন্ধ্যা শেষের খবর দিল রাত্রিকে আর বনে রাত্রি নামল। জলে রাত্রি নামল। পাড় ঘেঁষে ঘাটে নোঙর করল নৌকা। যন্ত্র থেমে গেল। প্রকৃতি বিরুদ্ধতা থেকে প্রত্যাবর্তন করল প্রাকৃতিক স্তব্ধতায়।
জোয়ারের সময় এল তখন। পরতে পরতে জল এসে ঢেকে দিল ঢালু পাড়। নৌকা ক্রমশ উঠছে। উঁচু পাড় বরাবর হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন মদ খেয়ে গড়িয়ে পড়েছেন রবিদা। সঙ্গে আরও কেউ কেউ। ঘাটের ধাপ একটি একটি করে ডুবে যাচ্ছে। আর চাঁদ উঠছে। অন্নপ্রাশনের থালার মতো চাঁদ। একটু পুরনো কাঁসার। হতে পারে ঠাকুরমার দান। কারণ মস্ত চাঁদের গায়ে হলুদে সোনার আভায় লালের আবেশ। ঝকমকে নয়। বরং পোড়া পোড়া। বরং অনেক বড়। বরং অনেক কাছাকাছি। শুভদীপ স্তব্ধ হয়ে দেখছে। চাঁদ দেখছে। তার ঋজু হালকা শরীর। দীর্ঘ শরীর। বাবলা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে এই শরীর দীর্ঘ-দীর্ঘ-দীর্ঘতর হয়ে আকাশের গায়ে প্রায় চাঁদ ছুঁই-ছুঁই। জ্যোৎস্নার আভায় কী অপরূপ সে। কী অসামান্য সুন্দর হয়ে ওঠা।