যেমন সে নিজে, যেমন সে ঘৃণা করে চন্দ্রাবলী আর প্রত্যেকবার তার বিবাহপ্রস্তাব নাকচ করে দেয় অর্থনৈতিক অক্ষমতার কারণে। প্রকৃতপক্ষকে সে আবডালে রাখে। সন্তর্পণে গোপন করে সত্যকে এবং জানতে দেয় না ঘৃণা। জানতে দেয় না অপছন্দ। বলে না যে একমাত্র চন্দ্রাবলীকেই সে বিবাহ করতে পারে না।
একটি গাড়ি ধোঁয়া ছড়িয়ে চলে যায়। ধোঁয়া লাগে শুভদীপের গায়ে। সে অপস্রিয়মাণ গাড়িটিকে দেখে ও ভাবে এই গাড়িও তার জীবন কি না। এবং সে ঘুরে দাঁড়ায়। নিশ্চিত হয়। যা কিছুই ঘটছিল চারপাশে, সবই ছিল তার জীবন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অজ্ঞাত মানুষের ঠিকানাও তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্মাবধি। পৃথিবীর সব মানুষই আসলে নিজের জীবনের সঙ্গে যাপন করছে কোটি কোটি জীবন। সে একজন মানুষ, সে যদি স্থির হয়, তাকে ঘিরে আবর্তিত জগতের প্রতি বিন্দু তারই জীবন। শুধু মৃত্যু আলাদা। মৃত্যু তার একার। মৃত্যু যার-যার তার-তার। একজনের মৃত্যুতে থেমে যায় না অন্য কোনও জীবন।
সহসা সে হাত মুঠো করে। মনে মনে পদাঘাত করে নিজেকে। জীবনকে ভাবছে সে! কেন! তার আর জীবনকে প্রয়োজন নেই! সে মৃত্যুকে জানতে চায়। মৃত হয়ে উঠবার আগে মৃত্যুর অসামান্য নিরপেক্ষতার স্বাদ ও সন্ধান সে পেতে চায়।
গোরস্থানের প্রবেশদ্বারে ধাক্কা দেয় সে। একটি পাল্লার মাঝবরাবর একটি ছোট দরজা, দরজার মধ্যে দরজা, নিঃশব্দে খুলে যায়। সে নিচু হয়ে প্রবেশ করে ভিতরে আর তার সামনে থরে থরে সাজানো দেখতে পায় হিমেল জীবন।
ডিসেম্বরের বিকেলে এই শহরেরই মধ্যবর্তী এক উঁচু প্রাচীর পেরোলেই শীত এসে জাপটে ধরে জানত না সে। তার হাত দুটি শীতল হয়ে যায়। বাম থেকে ডানে ক্রমান্বয়ে দৃষ্টি ফেরাতে থাকে সে। তখন মানুষটি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকেন। পীরের দরগার জন্য যে ঘেরা জায়গা, তার বাইরে একটি বেঞ্চে তিনি বসে আছেন। শুভদীপের জন্য দরজা খুলে দিয়ে ফিরে গেছেন সেখানে। ডাকছেন এখন। শুভদীপ এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। বয়স্ক ছোটখাটো মানুষ। সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরা। সাদা চুল। সাদা দাড়ি। মাথায় গোল টুপি। মুখে দৃঢ়তা। চোখে সারল্য। কিন্তু কপালের মাঝ বরাবর সমান্তরাল সরলরেখা হয়ে ফুটে আছে জিজ্ঞাসা। কেন এসেছে সে। সে উত্তর দিচ্ছে, তার শান্তির জিজ্ঞাসা। শান্তির সন্ধান। মৃত্যু বলছে না সে। এই বিদগ্ধ মানুষটির কাছে এসে আর মৃত্যু বলছে না। শান্তি বলছে। এই মৃত মানুষদের সান্নিধ্যে, এই গাছপালার ছায়ায়, পাশাপাশি শুয়ে থাকা নিবিড়তার মধ্যবর্তী এই শৈথিল্যে, মানুষের অন্তিম পরিণতির এই মহাস্থানে তার শান্তির খোঁজ।
মানুষটির মুখ সম্রান্ত হাসিতে ভরে যায়। তারপর তাতে প্রসন্নতার স্পর্শ লাগে। তাঁর প্রসন্ন হাসি মুখমণ্ডলে বিস্তারিত হতে হতে গাল বেয়ে, কাঁধ বেয়ে, মাটিতে বকুলফুলের মতো ঝরে পড়ে টুপটা তিনি ইঙ্গিতে মাথা ঢেকে নিতে বলেন। শুভদীপ মাথায় রুমাল জড়িয়ে নেয়। সন্ধে নামলেই যেন সে বেরিয়ে যায়। বৃদ্ধ মানুষ বকুল ঝরিয়েই বলেন। সে সম্মত হয় এবং পাখ-পাখালির ডাকে সন্ধ্যার সমাগত স্বরের ইশারা পায়। এখানে এই ঘেরা জায়গায়, ঘন গাছের গা ঘেঁষাঘেষি অবস্থানে সন্ধ্যা দ্রুত নামে। ছায়া জমে জমে হয়ে যায় ঢিপি-ঢিপি অন্ধকার।
সারি-সারি কবরের মধ্যবর্তী পথ বেয়ে হেঁটে যায় সে। বৃদ্ধ মানুষটি তার পাশাপাশি। এইখানে শায়িত মানুষেরা শান্তিতে আছেন—ঘোষণা করেন তিনি। তৃপ্তি ও শান্তি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত ব্যাখ্যা করে যান। সেই মতামত ধ্রুব। সমস্ত জীবন অসংখ্য উপলব্ধির মাধ্যমে এই ধ্রুবত্বে তিনি পৌঁছেছেন। তাঁর ছেলে মারা গিয়েছে যক্ষ্মায়। একমাত্র সন্তান। সেই মৃত্যুশোক হরণ করেছে তাঁর স্ত্রীকে। এ জগতে আপনার বলতে টিকে ছিল একটিমাত্র ন্যালাখ্যাপা ভাই। পাঁচ বছর আগে রেলের তলায় সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। রেলব্রিজের ওপর দিয়ে সে সংক্ষিপ্ত সময়ে পার হয়ে যেতে চেয়েছিল। পারেনি। সে যখন ব্রিজের মাঝবরাবর, তখন রেলগাড়ি এসে পড়ে। প্রাণভয়ে সে দৌড়েছিল, চালকও গতি রোধক যন্ত্রে দিয়েছিল টান। কিন্তু যা হবার তা হল। তার দেহের টুকরো-টাকরা কিছু ব্রিজে রইল, কিছু পড়ল নীচের রাস্তায়।
অপরূপ হাসি তাঁর মুখে বিস্তার পায় এবার। আর বিস্তার পেতে পেতে অনন্তে মেশে। অপরূপ এই হাসি। অপূর্ব। কেন-না, তিনি স্মরণ করেন, ভাইয়ের শরীরের প্রতিটি টুকরোই, যা নীচে পড়েছিল ও যা ছিল ওপরে, তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। সহজ ছিল না সেই কাজ, কিন্তু তিনি সম্ভব করেছিলেন। রেলের আরক্ষাকর্মীরা তাঁকে সাহায্য করেছিল। নিশ্চয়ই করেছিল।
ন্যালব্যাপা ভাই তাঁর। সংক্ষেপে পথ পেরোতে চেয়েছিল। পারেনি। তার সেই অপারঙ্গমতায় এই মানুষটি একা। নিশ্চিতই একা।
পাকা চুল ও দাড়ি সমেত নিশ্চয়তার মাথা নাড়েন তিনি আর তৃপ্তির কথা, শান্তির কথা বলেন। এই যে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন তিনি, গোটা গোরস্থানের দেখ-ভাল—এই নিয়ে তিনি তৃপ্ত। তাঁর কোনও অভিযোগ নেই, আক্ষেপ নেই। তাঁর এখন একটিমাত্র চাওয়া—একবার ঘুরে আসবেন ফুরফুরা শরিফ। তাহলেই শান্তিতে ভরে যাবে তাঁর মনু। আর আল্লার ডাক পেলেই তিনিও শুয়ে পড়বেন স্ত্রী-পুত্র-ভাইয়ের কবরের কাছাকাছি।
কথা শেষ হয়। তিনি থমকে দাঁড়ান। শুভদীপও দাঁড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। এবং বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে বৃদ্ধের আত্মস্থ রূপ। কোন অসীমে মিলেছে তাঁর দৃষ্টি। যেন তাঁর স্ত্রী, ছেলে আর ভাইয়ের অস্তিত্বকে স্পর্শ করে ফিরে আসছে।